• ২০ মে ২০২১ ২৩:৫০:৩৫
  • ২০ মে ২০২১ ২৩:৫০:৩৫
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

ফাগুন চলে যাবার দুই বছর: মুছে দেয়া সব কথা মনে রাখা হবে

সাংবাদিক ও কলাম লেখক কাকন রেজা।


কাকন রেজা :


আমার একটা ব্লগ রয়েছে। গুগলের ব্লগ। সেখানের একটি লেখাকে বিপজ্জনক মনে করে ডিলিট করেছে গুগল। গুগলের ‘তৈরি’ কথাটি এখানে আবার তুলে দিই। ‘Your post titled "‘সব মনে রাখা হবে সবকিছু মনে রাখা হবে’" was flagged to us for review. We have determined that it violates our guidelines and deleted the post’, খুব কমন অজুহাত।

আমির আজিজ এখন কতটা ভয়ের কারণ হয়েছে তা গুগলের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়। গুগলের ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর পার্ট এবং ভারতের বন্ধুদের সবার কাছেই কবি, আন্দোলনকর্মী আমির আজিজ একটি ভয়ের নাম। শুধু আমির আজিজ নয় আজাদি’র উচ্চারণ আর জান-জবানের পক্ষে সব লেখাই এখন ফ্যাসিস্ট আর করপোরেটদের জন্য ভয়ের বিষয় এবং এসবের পক্ষে থাকা মানুষেরাও। ফিলিস্তিন থেকে দক্ষিণ এশিয়া সব তার উদাহরণ।

আমার লেখাটার বিষয় ছিলো আমার খুন হয়ে যাওয়া ছেলে, যে কিনা একটি গণমাধ্যমের সহসম্পাদক ছিলো, সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, যাকে অনেকে জানেন, জানতেন ফাগুন রেজা নামে। আমার এক বন্ধু আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছায় লিখেছিলেন, ‘মৃত্যু তো তোর আগেই হয়ে গেছে’, এমন কথা। তার সেই কথাকে ঘিরেই ছিলো আমার সেই লেখাটি। না, খুব বিপ্লবী কোনো লেখা নয়, একজন সন্তানহারা পিতার শোকের প্রকাশ। লেখায় কারো বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়নি। কোনো ফ্যাসিস্ট বা করপোরেট দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধেও সেভাবে যায়নি লেখাটি। লেখাটির শেষ দুটি প্যারা নিচে দিলাম, পড়ে দেখলেই বোঝা যাবে। শোক ছাড়া কিছুটা ক্ষোভ হয়তো আছে, যা একজন বাবার জন্য স্বাভাবিক, এর বেশি কিছু নেই সে লেখাতে।

“ফাগুন দেশটাকে ভালোবাসতো। তাইতো দেশের বাইরে যাবার সকল সম্ভাবনা থাকা সত্বেও দেশেই রয়ে গিয়েছিলো। চেয়েছিলো নুইয়ে পড়া কিছু উজবুকের রাজ্যে মাথা উঁচু করে কাজ করতে। নিজে বাঁচতে ও অন্যকে বাঁচাতে। পারেনি। উজবুকের মাথা নিজের বুকে লেপটে থাকে, ফাগুন মানুষ ছিলো। নতমুখে কুর্নিশ করা ফাগুনের ধাতে ছিলো না, রক্তে ছিলো না।

৬ মার্চ ছিলো আমার জন্মদিন। আমি ইচ্ছে করেই ভুলে ছিলাম দিনটি। ‘হ্যাপি বার্থ ডে আব্বুজি’ ডাকটি আর শুনতে পাবো না, এটা মেনে নিতে মন সায় দিচ্ছিলো না বলেই ভুলে থাকা। ভুলে থাকা কি যায়? যায় না। সব মনে থেকে যায়, পড়ে যায়। সাথে ক্ষুব্ধ মনে বসে থাকা আমির আজিজ বলে ওঠেন, ‘সবকিছু মনে রাখা হবে, সব মনে রাখা হবে’।”

দেখলেন তো, এই ছিলো লেখার মূল কথা। অথচ ভারত নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ এশিয়ার গুগল আমির আজিজের এই শব্দগুচ্ছ মেনে নেয়ার সাহস রাখেনি। ‘সব কিছু মনে রাখা হবে, সব মনে রাখা হবে’, শুধুমাত্র এই মনে রাখার ভয়েই গুগল লেখাটাকে ডিলিট করে দিয়েছে। বলেছি তো ফ্যাসিস্ট আর করপোরেটদের কথা। গুগল হলো করপোরেট আর ফ্যাসিস্ট কারা সে কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। করপোরেট মগজ জানে যেখানে ফ্যাসিস্ট সেখানেই ধান্ধা, টাকার খনি। তাই ফ্যাসিস্টদের স্বার্থরক্ষা করপোরেটদের একান্ত ধর্ম। আর করপোরেটদের তোষণ হলো ফ্যাসিস্টদের টিকে থাকার উপায়।

ফ্যাসিজমের জনসম্পৃক্তি থাকে না। ফ্যাসিস্টরা হয় জনসমর্থনহীন। তাই তাদের টিকতে হয় বিকল্প পথে। তাদের পতনও হয় বিকল্প রাস্তায়। হিটলার, মুসোলিনি সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাথে স্মরণ করিয়ে দেয়, জনগণ সবকিছু মনে রাখে, সব মনে রাখে। সুতরাং গুগল যে কাজটি করেছে, সেটাই গুগলের জন্য স্বাভাবিক। ফেসবুকের একই কথা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে ‘সোশ্যাল’ তথা ‘সামাজিক’ শব্দটার মানে হলো ‘রঙ-ঢং, হাসি-ঠাট্টা’, আর পণ্যের বিজ্ঞাপন। এখানে অধিকারের কথা বলতে গেলেই তা ‘অসামাজিক’। আপনি ক্ষুধার কথা বলবেন, দাবি করবেন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের, বিচার চাইবেন খুন-ধর্ষণের, আপনি তাহলে ‘অসামাজিক’ আপনার লেখা ডিলিট করে দেয়া হবে। আপনাকে ‘ব্যান’ করা হবে। সুতরাং ফ্যাসিস্ট ও করপোরেট দুনিয়ায় আপনাকে চুপ থাকতে হবে। হতে হবে ‘সাত চড়ে রা নেই’ টাইপ সুবোধ বালক।

আচ্ছা বলুন তো, লেখা ডিলিট করলেই কি সন্তানহারা বাবার বুকের কষ্ট, ক্ষোভ মুছে যাবে? মুছে যাবে মধ্যবয়সী বাবার তরুণ সন্তান হারানোর ব্যথা? যাবে না। যে বাবার ছেলে নিখোঁজ হয়, তারপর তার লাশ পাওয়া যায় রেললাইনের ধারে। সেই বাবার বুকের ভেতর সবসময়ই বয়ে চলে কষ্টের রেল আর ক্ষোভের হুইসেল। সেই রেল আর হুইসেল গুগল কী দিয়ে ডিলিট করবে! কী দিয়ে মুছে দেবে বুকের আগুন আর দু’চোখের অশ্রু চিহ্ন!

আজ ফাগুন চলে যাওয়ার দু’বছর পূর্ণ হলো। সময়ও তো পারেনি বাবার বুকের ক্ষত মুছে দিতে। বরং সময়ের শোক জমে জমে শক্ত হয়, শক্তি হয়। অশ্রুও হয়ে ওঠে নুনের পাথর। সেই নুনের পাথর শক্ত হতে হতে শোকের শক্তিতে প্রতিরোধ হয়ে যায়। বিপ্লব হয়ে ওঠে। সেখানে গুগল আর কতটা পারবে। কতটা পারবে ফ্যাসিজম আর করপোরেটরা। প্রমেথিউসের কলিজার মতন যে ব্যথা বারবার ফিরে আসে, তৈরি হয়, সেটাকে ডিলিট করা যায় না। কোনভাবেই মুছে দেয়া যায় না। সে ব্যথা-কষ্ট আর ক্ষোভ যুগে যুগে একজন আমির আজিজ হয়ে যায়, বলে যায়, ‘সব ইয়াদ রাখখা জায়ে গা, সবকুছ ইয়াদ রাখখা জায়ে গা’। ‘সব মনে রাখা হবে, সবকিছু মনে রাখা হবে’।

পুনশ্চ : সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা’র হত্যার ঘটনাটি মনে করিয়ে দিতে ডয়চে ভেলে’তে প্রকাশিত খবরটির লিঙ্ক দিলাম। কেউ জানতে চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

সংবাদ প্রকাশের কারণেই কি খুন হলেন ফাগুন? 

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজা’র পিতা।

সংশ্লিষ্ট বিষয়

কাকন রেজা ফাগুন রেজা

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1536 seconds.