• ০১ জুলাই ২০২১ ১০:৩৮:১৬
  • ০১ জুলাই ২০২১ ১০:৩৮:১৬
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

আহমদ ছফা: দেবতা, মহাত্মা না মানুষ

ছবি : সংগৃহীত

কাকন রেজা :
আবেগ বাঙালের একটা দোষ। যা গুন হবার কথা ছিলো তা অতি প্রয়োগে দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ হলো দোষেগুনে। বুদ্ধিজীবীরাও তাই। তারা দেবতা নন। যারা চিন্তা করেন, তাদের সব চিন্তাই সঠিক এমন ভাবাটাও ভুল চিন্তা। গান্ধিজি মহাত্মা হয়েছিলেন একটা পর্যায় পার হয়ে। তার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা কন্টিনিউটি ছিলো। কিন্তু আহমদ ছফা’র নামের আগে আবেগতাড়িত ‘মহাত্মা’ শব্দটির প্রয়োগ বিবেচনার দাবি রাখে।

আহমদ ছফা’র কাজে ও লেখায় অসংখ্য কন্ট্রাস্ট ছিলো, আছে। রাজু আলাউদ্দিন তার এবং আরেকজনের নেয়া আহমদ ছফা’র একটি সাক্ষাতকার পোস্ট করেছেন সামাজিকমাধ্যমে। যেটা লুপ্ত ‘বাংলাবাজার’ কাগজের তরফ থেকে নেয়া হয়েছিলো। সেখান থেকেই একটা অংশ তুলে দিই। সেটুকুতেই দেখা যাবে আহমদ ছফা’র কন্ট্রাস্টের রূপ। 

ছফা বলছেন, ‘আজকে বিএনপি সরকারের রবীন্দ্রজয়ন্তী করার কথা না। খালেদা জিয়া রবীন্দ্রনাথ বোঝে না, [তবু তারা এটা] এ কারণেই করে যে, এটার সামাজিক ডিমান্ড আছে। সুতরাং সামাজিক ডিমান্ড হচ্ছে রাজনীতির চেয়ে বড়। আমাদের রাজনীতির বয়স কত? ৩০ বছর? কিন্তু বাংলাদেশের সমাজের বয়স ১০০০ বছর।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সবচাইতে বড় গুণ হল এই, অন্যান্য লেখকরা সব সময় চলমান রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন, তিনি লিখেছেন সমাজ নিয়ে। সমাজটা হাজার বছরের, পলিটিক্সটা খুব রিসেন্ট। এখানে সবাই পলিটিকস করতে চায় কিন্তু সমাজকে বাদ দিয়ে। পলিটিকস যদি সমাজকে কন্ট্রোল করে তাহলে এর ফল শুভ হয় নয়। সমাজই পলিটিকস কে নিয়ন্ত্রণ করবে।’ 

সেই সময় সরকারে বিএনপি ছিলো। আর খালেদা জিয়ার সমালোচনাও সহজ ছিলো। সেই সহজ সুযোগটাই ছফা নিয়েছিলেন। যাকগে কথা সেটা নয়। কথা হলো, খালেদা জিয়া বা যে কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাপক, তার রবীন্দ্রনাথ বোঝা কেন আবশ্যিক। রাষ্ট্রে নানা ধর্ম আছে, সংস্কৃতি আছে শাসকদের তার সব বুঝতে হবে কেন, কেনই বা আত্মস্ত বা মুখস্ত করতে হবে!

বুঝলাম রবীন্দ্রনাথ সমাজ নিয়ে লিখেছেন। ছফা বলছেন, ‘সমাজটা হাজার বছরের, পলিটিক্স রিসেন্ট।’ আশ্চর্য, বাচ্চার কান্নার মাধ্যমে দুধের দাবিও যে রাজনীতি এটাতো রাজনীতির প্রাক-প্রাথমিক পাঠ। আর ছফা বললেন, পলিটিক্স রিসেন্ট। অদ্ভুত না! আবার এর সাথে সুরও মেলালেন অনেকে। রাজনীতিকে সমাজ থেকে বাদ দিলে সমাজটা আর থাকে কই। এই প্রশ্নটা করারও সাহস কারো হয়নি। হয়নি কারণ তাদের মাইন্ডসেটিং। তারা মস্তিষ্কে রোপন করে নিয়েছিলেন, ছফাকে প্রশ্ন করা যাবে না, তিনি যা বলবেন তাই ঠিক, বিশুদ্ধ। অথচ পলিটিক্স-ই সমাজ নির্মান করেছে। যেমন মানুষ রাষ্ট্র নির্মান করেছে তাদেরই প্রয়োজনে। আর রাষ্ট্র নির্মানটাই পলিটিক্স। 

সমাজ পলিটিক্স নির্মান করে না, পলিটিশিয়ান নির্মান করে। এটা খুব কঠিন কথা নয়। অথচ ছফাকে কেউ প্রশ্ন করেননি। ছফাকে এমন দরকারি প্রশ্নটিও করা হয়নি, এই যে আমাদের রাজনীতির বয়স ৩০ বছর বললেন, তাহলে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন কি আমাদের রাজনীতি ছিলো না! আমরা রাজনীতি শুরু করেছিলাম আমাদের রাষ্ট্র নির্মানের জন্য। আর সেই রাজনীতি নিশ্চয়ই রাষ্ট্র নির্মানের পরে শুরু হয়নি। তাহলে আমাদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না। বলা হতো না, স্বাধীনতার পর আমরা কী পেলাম, আর কী চেয়েছিলাম আমরা। হায়দার হোসেন গানে বলতেন না স্বাধীনতাটা খোঁজার কথা। খোদ শাহবাগ আন্দোলনই সৃষ্টি হতো না। 

এই যে প্রশ্ন না করার অভ্যাস এর ফলেই ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটে। আর ছফারা নোম চমস্কি হন। যাদের প্রতিবাদে ফ্যাসিজমের ভিত কাঁপে না, কিন্তু কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হন। বিশেষ করে তরুণরা। আর কিছু বুদ্ধিজীবী বছর ধরে তাকে নিয়ে আলাপ করে নিজেকে জাহির করতে পারেন। এমনকি ফ্যাসিস্টরাও এমন সব মানুষদের সুনাম গায়। 
ছফার উদ্ধৃতি ধরে বলছি, রবীন্দ্রনাথ সমাজ নিয়ে লিখেছেন, তা না পড়লে কি রাষ্ট্র চালানো অসম্ভব? নাকি রবীন্দ্রনাথ সমাজ নিয়ে একাই লিখেছেন, অন্য কেউ লিখেননি, বলেননি! সমাজের ধারণাটা কি রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শুরু! এখানে ছফাই বলছেন, সমাজটা হাজার বছরের। আবার তিনিই ধারণা দিতে চাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ না পড়লে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপক মূর্খ। আজব না। 

একটা না, এমন অসংখ্য বিভ্রান্তি, কন্ট্রাস্ট রয়েছে ছফার লেখায়। সুতরাং ছফারও সমালোচনা সম্ভব। যারা মনে করেন, সমালোচনাটা অসম্ভব। যারা হঠাৎ করেই মানুষকে বিশেষিত করেন এবং নামের আগে উপাধি জুড়ে দেন, তাদের চিন্তার চেয়ে কাজ বেশি কাজ করে আবেগ। বাঙালদের মধ্যে যারা লেখালেখি করেন, তাদের মধ্যে এই আবেগটা আরো বেশি। এই আবেগ কবিতা বা ফিকশনে প্রযোজ্য, নিবন্ধ-প্রবন্ধে অচল। এই অচল জিনিসে ভর করেই তারা অচল লেখা চালিয়ে দিতে চান। যুক্তিকে আবেগে ভাসিয়ে দিতে চান। 

সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতন দার্শনিকরাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাদের চিন্তাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। প্লেটো যে ধারায় সাম্যবাদের চিন্তা করেছেন সেই চিন্তারও পরিবর্তন ঘটেছে। অনেকের মতে আধুনিক সাম্যবাদ প্লেটোর কাছ থেকে ধার করা। এমন কথাও হাস্যকর। চিন্তার উৎপত্তি আছে, নদীর উৎসের মতন। চিন্তার উৎপত্তি হলেই তো তা নিয়ে আলোচনা হবে, তার বিকাশ ও বিবর্তন হবে। প্রয়োজনে উল্টে যাবে কিংবা বাতিল হয়ে নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটবে। এটাই নিয়ম। চিন্তার উৎপত্তি ঘটলেই বিকাশ কিংবা পরিবর্তন সম্ভব। বিবর্তনবাদ যেমন এখন বাদের খাতায় তেমনি। 

অথচ আমাদের স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা এই নিয়মটা মানতে চান না। অবশ্য তাদের এই না চাওয়াটা তাদের চিন্তার স্বপক্ষের জন্যই। তারা যুক্তি নয় সবকিছু আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। সব স্বপক্ষে রাখতে চান। অথবা বলতে পারেন, আবেগটা তাদের ছল। যেটা চাণক্য শিখিয়ে ছিলেন। তারা মূলত সাধারণ মানুষের দুর্বল জায়গাটা কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থটা সিদ্ধ করতে চান। 

পুনশ্চ : আহমদ ছফা’র নামের আগে মহাত্মা যুক্ত করা হলো দেবত্ব আরোপের চেষ্টা। মানুষ যখন দেবতা হয়ে ওঠে, যখন সমালোচনা ঊর্ধ্বে চলে যায়, তখন তার সব চিন্তাও অর্থহীন হয়ে যায়। সমালোচনার অযোগ্য চিন্তা কোনো কাজের কথা নয়। এ কথা বাঙাল বুদ্ধিজীবীদের কে বোঝাবে। আহমদ ছফা যদি টিকে থাকেন তার কর্মেই টিকবেন। সক্রেটিসের মহাত্মা হয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। হাজার বছর। সময়টা যেতে দিন কে মহাত্মা তা সময়ই নির্ধারণ করে দিক। 

শেষ কথা : আহমদ ছফা আমারও পছন্দের মানুষ। কিন্তু তাকে দেবতা বানানোর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমার এই প্রতিবাদ।

কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক। 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1557 seconds.