ছবি : সংগৃহীত
কাকন রেজা :
ডার্ক কমেডি, যাকে বলা হয় ফাঁসির হাস্যরস, মর্বিড হিউমার। বাংলাদেশে আজ চারিদিকে ডার্ক কমেডির ছড়াছড়ি। অসংখ্য ডার্ক কমেডিয়ান নেমে পড়েছেন স্টেজে। মানুষের মৃত্যুও আজ যাদের কমেডির বিষয়বস্তু। মরলেও চোখটা বেঁচেছে, এটাও ডার্ক কমেডি; আমরাও বলতাম একসময় এবং তা বলতাম না বুঝেই। কারণ ‘ডার্ক’ ব্যাপারটিই আমাদের সময় দৃশ্যমান ছিলো না। অন্ধকারের উপাখ্যান ছিলো আমাদের অজানা। আমরা নিশ্চিত মনে বাড়ির বাইরে যেতাম, নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো না, ছিলো না লাশ হবার সমূহ আশঙ্কা। এখন যেমন আছে।
ধরে নিন, একজনকে হাত-পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে ছেড়ে দেয়া হলো, সঙ্গতই সে পারবে না। তখন যদি বলা হয়, আপনি সাঁতারে ব্যর্থ। শেষ পর্যন্ত সে যদি ডুবে মারা যায়, তখন যদি বলা হয়, ‘জন্ম-মৃত্যু ঈশ্বরের হাতে’, কী বলবেন আপনি? জানি, চুপ হয়ে যাবেন। এটাই ডার্ক কমেডি, আর এই কমেডিতে চুপ হয়ে যাওযা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
ডার্ক কমেডিতে ডার্ক ম্যানরাই হাসতে পারে। যাদের জগত অন্ধকারে ভরা, যাদের উত্থান অন্ধকার থেকে, যাদের চিন্তা অন্ধকার। যারা মূলত অন্ধ। মতান্ধ। ডগমাটিক। তাদের কাজ মানুষের কষ্ট ও বেদনা বিষয়ে হিউমার করা, মর্বিড হিউমার। খুনি এরশাদ শিকদারের গানের মতন। যে অন্যের মৃত্যুকে নিশ্চিত করে নিজে মৃত্যু বিষয়ক গান গাইতো, ‘আমি তো মরেই যাব’। ভয়াবহ এই ডার্ক কমেডি, মর্বিড হিউমার। এক এরশাদ শিকদারকে সে সময়ের সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। কিন্তু শিকদারের আধ্যাত্মিক বা ভৌতিক জননকে কি রোখা গেছে? যায়নি।
একজনের স্বাভাবিক মৃত্যুতে সান্ত্বনার কথা হতে পারে, ‘ঈশ্বরের মর্জি’ বিষয়ে। কিন্তু একজন রোগী যখন হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মারা যায়, তখন যখন ‘ঈশ্বরের মর্জি’ কথাটি উত্থাপিত হয়, তখন সেটা ডার্ক কমেডি, মর্বিড হিউমার। চলতি করোনাকালে এমন মৃত্যুর দৃশ্য আমাদের অনেক দেখা, এমন ডার্ক কমেডিও অনেক শোনা। ওই যে, মর্বিড হিউমার, মৃত্যু বিষয়ে হাস্যরস সয়ে নিতে হয়। তাই চুপচাপ সয়ে নেয়া। অক্ষমদের আর কিই বা করার আছে!
সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী থেকে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে। বিপরীতে ব্যবস্থা হচ্ছে শুধু লাইসেন্স দেখা, সেটা চালকের কিংবা গাড়ির যাই হোক না কেন। কিন্তু লাইসেন্স দিয়ে কি চালকের মানসিকতা চেক করা যায়? সে অপরাধ প্রবণ কিনা তা বোঝা যায়? যায় না। একটা ঘটনা বলি, একজন শিক্ষিত মানুষ যিনি লাইসেন্স পাননি গাড়ি চালানোর, অর্থাৎ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। অথচ তার ড্রাইভারের লাইসেন্স আছে। যে ড্রাইভার শুধু নাম-দস্তখত করতে পারেন। একটা লাইন তার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। তারপরেও তার লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্স পেতে গেলে হাতে-কলমের সাথে লিখিত পরীক্ষাটাও দিতে হয়। এই যে বকলম ড্রাইভারের লাইসেন্স প্রাপ্তি, এটাও একটা ডার্ক কমেডি। তার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে কেউ মরে গেলে যদি বলা হয়, ‘ঈশ্বরের মর্জি’ সেটা আরো বেশি মর্বিড হিউমার। এমন লাইসেন্স মানে, ‘লাইসেন্স টু কিল’। একজন অন্ধের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেয়ার চেয়ে বড় ডার্ক কমেডি আর কী হতে পারে!
লাইসেন্স চেক করার চেয়ে লাইসেন্স কার হাতে আছে সেটা চেক করা জরুরি। শুধু গাড়ির ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রেই তা চেক করা জরুরি। অন্ধ, মতান্ধ তথা ডগমাটিকদের হাতে সব স্টিয়ারিং-ই বিপজ্জনক। তাদের হিউমার মানে মর্বিড হিউমার, কমেডি হলো ডার্ক কমেডি।
লেখক ও সাংবাদিক।