ছবি : সংগৃহীত
কাকন রেজা :
‘দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’, এই কথা নিয়ে অনেক কথা চালাচালি হচ্ছে। আলমগীর কবির নামে একজন এমন একটি প্রচারপত্র টানিয়েছেন দেয়ালে। যিনি আমাদের এক শ্রেণির ‘সাংবাদিক’দের কাছে বিশাল অপরাধ করে ফেলেছেন। এসব ‘সাংবাদিক’দের বংশ পরম্পরার কেউই হয়তো ‘লজিং মাস্টার’ শব্দটার সাথে পরিচিত নন। তারা সবাই ‘জমিদার’ তনয়। তাই আলমগীর কবিরের মতন একজন বেকার কর্মহীন মানুষের আকুতি তাদের অহং-এ লেগেছে। এসব ‘সাংবাদিক’দের সম্পর্কে বলে নিই। বিশ্বের সব বড় বড় গণমাধ্যম তাদের কর্মীদের সংবাদদাতা নামে অভিহিত করে। আমাদের দেশে সেই সংবাদাতা যখন একলাফে ‘সাংবাদিক’ হয়ে ওঠেন, তখনই ঝামেলাটা মানে ‘ইগো’টা বেড়ে যায়। তসলিমার ভাষায় বলতে পারেন, ঝুলে থাকে। ঝুলে থাকা ‘ইয়ে’টাই তাদের ‘সাংবাদিক’ নামের ইগো। সেই ‘সাংবাদিক’দেরই আলমগীর কবির দুঃখ দিয়েছেন। কেউ কেউ এরমধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধও খুঁজে পেয়েছেন। তাদের নাকের অবস্থা এত ভালো যে, এত বেশি টাকা দিয়ে ডগ স্কোয়াড না পুষে তাদেরকে পোষা যেতে পারে। শামীম ওসমান যেমন বলেছিলেন পোষার কথা।
হাতেগোনা কিছু মানুষ ধনী হয়ে উঠলেই সামগ্রিক সামাজিক চিত্র বদলে যায় না। উড়াল সড়ক, সেতু ধরণের ইট-পাথরের জঞ্জাল মানুষের ভালো থাকার গ্যারান্টি নয়। জার্মানির বার্লিন শহরে যারা গেছেন, তারা জানেন, সেখানে বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার নেই। চেষ্টা করা হয়েছে পুরানো চেহারা ধরে রাখতে। যতটা সম্ভব কংক্রিটের জঞ্জাল কমানোর। উল্টো দিকে মানুষের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো তারা নিশ্চিত করেছে। বাঁচার মতন বেঁচে থাকা যাকে বলে।
বেসিক নিড’র সাথে কোনো আপোস করেনি তারা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। যার ফলে সেখানে আলমগীর কবিরের মতন কাউকে ‘ভাতের জন্য পড়ানো’র আবেদন জানিয়ে পোস্টার সাঁটাতে হয় না। এর ঠিক উল্টোচিত্র আমাদের দেশে, গুটিকয়েক স্কাইস্ক্র্যাপারে বিপরীতে হাজারো বস্তি। হাজারো গৃহহীন মানুষ। যেখানে মানুষের জীবন তো ‘দূর কা বাত’ নিরাপদ মৃত্যুটাকেও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। মেজর সিনহা সহ ১১৪টি ক্রসফায়ার যার সাক্ষ্য দেয়।
আমাদের দেশে দরিদ্র ঘরের ছেলেরা বরাবরই পরের বাড়িতে ‘লজিং’ থেকে পড়াশোনা করেছে। ‘লজিং মাস্টার’ শব্দটি আমাদের জন্য নতুন নয়। কিন্তু আমাদের দেশের তথাকথিত ‘সাংবাদিক’দের কাছে নতুন। একবার বাংলা সিনেমার এক নায়িকার ন্যাকামি নিয়ে কাগজে একটি খবর হয়েছিলো। যে নায়িকা এখন কলকাতায় পরবাসিনী। তিনি তার মার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মা চোর কী’ এমন একটা কথা। আমাদের সেইসব ‘সাংবাদিক’ নামক সাংঘাতিকদের ‘লজিং’ শব্দটি না জানার সাথে একজন বেকার কর্মহীন মানুষকে নিয়ে নানা গন্ধ খোঁজার অভ্যাস সেই নায়িকার কথাই মনে করিয়ে দিলো।
আলমগীর কবিরকে পুলিশ একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। প্রশংসনীয় কাজ। একজন মানুষকে অন্তত তার হতাশ জীবন থেকে আপাত মুক্তি দেয়া সম্ভব হয়েছে। সব ঠিক আছে। কিন্তু এই ঠিক থাকার মধ্যেও একটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যায়। এটা কি পুলিশের কাজ? এর জন্য সরকারের একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। রয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। তারা কী করলেন? কেন পুলিশকে খুঁজতে হবে আলমগীরকে। কেন তথাকথিত সাংবাদিকরা তাকে পুলিশী ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ এর সম্মুখিন করাবেন! কেন তাকে পুলিশের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে তার সমস্যা! সে কি বাধ্য তার ব্যক্তিগত সমস্যা, তথা দুর্বলতা, তথা অভাবের কথা কারো কাছে বলতে, ব্যাখ্যা করতে? না, আইনগতভাবে সে বাধ্য নয়। এমন হতো যদি রাষ্ট্র মানুষের সকল বেসিক নিড পূরণের ব্যবস্থা করেছে, তাহলে হয়তো আলমগীরের কাছে জানতে চাওয়ার আইনগত না হলেও একটা নৈতিক যুক্তি থাকতো।
দুবেলা ভাতের জন্য কাজ খোঁজা কোনো অন্যায় নয়। মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য। সুতরাং সে বৈধ যেকোনো উপায়ে তার এই মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। এমনকি বার্লিনের মতন শহরেও এমন পোস্টার সাঁটানোও কোনো অপরাধ কর্ম নয়। এমন নিরাপরাধ বিষয়ের জন্য তাকে কেন জেরার মুখে পড়তে হবে! সে হোক কথিত ‘সাংবাদিক’ বা পুলিশী জেরা। কেন তাকে প্রমাণ করতে হবে, সে অভাবী, বেকার! এর জবাব কি আছে কারো কাছে, আইনগতভাবে থাকার অন্তত কথা নয়। যা আছে তা হলো বাকোয়াজ।
আমাদের দেশের এক শ্রেণির সুবিধাভোগী, স্বার্থান্বেষী মানুষ আসল কাজ ফেলে আছেন এইসব বাকোয়াজ নিয়ে। যার ফলেই দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। যার জানান দিচ্ছে গ্লোবাল ইনডেক্স। গরীবরা ক্রমশ আরো গরীব হচ্ছে। উল্টো দিকে হাতেগোনা কিছু ফটকাবাজ ধনী হয়ে উঠছেন। যে ধন আলীবাবার চল্লিশ চোরের ধনপ্রাপ্তির কাহিনীকেও ম্লান করে দিচ্ছে। কথিত ‘সাংবাদিক’দের সেই চল্লিশ চোরের ধন প্রাপ্তির কাহিনী খোঁজার চেয়ে, আলমগীর কবিরের ভাত প্রার্থণার অকারণ ‘কারণ’ খোঁজা বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূলত এই দাঁড়ানো সেই চল্লিশ চোরদের প্রটেক্ট করার জন্য, যারা সাধারণ মানুষকে লুট করে সম্পদের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। যার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে শামীম ওসমানের ‘ইয়ে পোষা’ বিষযক বক্তব্যের মাধ্যমে।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।