ছবি : সংগৃহীত
ভাষা সৈনিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা লোকমান আহমদ আমীমী গত ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি মহান রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে পরলোকগমন করেন। তিনি ১৯২৮ সালে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানাস্থ বোয়ালিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
কর্মজীবনে তিনি প্রায় ৫৫ বছর (১৯৬৩ - ২০১৮) মোহাম্মদপুর ঈদগাহমাঠ জামে মসজিদে পেশ ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ঢাকা রেসিডেনসিয়েল মডেল কলেজের ধর্ম শিক্ষক হিসেবেও (১৯৭২ -১৯৯৬) তিনি কর্মরত ছিলেন।
ছাত্রজীবনে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় তিনি ৫২’র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারনা স্থান পেয়েছে বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত অমর একুশে স্মারক গ্রন্থে। পরবর্তীতে ‘বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যা দেখেছি’ শীর্ষক তাঁর রচিত ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা সংকলিত হয়েছে আহমদ রফিক ও এম আর মাহবুব সম্পাদিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও অনুষঙ্গ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে।
তিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ, বাংলা ছাড়াও আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় ছিল তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। আরবী ভাষায় আল্লামা হাফিজ ইবনুল কায়্যিম কর্তৃক রচিত রূহ বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘সিররূর রূহ’ বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি, যা কিনা ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে।
আমীমী তাঁর শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার তৎকালীন প্রধান মাওলানা ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতীব মুফতী আমিমুল ইহসান সাহেবের লিখিত একাধিক গ্রন্থ উর্দূ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: হাদিয়াতুল মুসাল্লিন (মুসলমানদের জন্য উপহার), তারিখে ইলমে হাদিস (হাদিস চর্চার ইতিহাস) ও তারিখে ইলমে ফিকহ (ফিকহ চর্চার ইতিহাস)। অনুবাদ করার পাশাপাশি তিনি দৈনিক পত্রিকায় সমসাময়িক ও ধর্মীয় বিষয়ে কলাম লিখতেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে মাওলানা আমীমী ঢাকার মোহাম্মদপুর জামে মসজিদের পেশ ইমাম হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন মোহাম্মদপুরে বাঙালিদের উপর সংঘটিত নারকীয় ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ। তাঁর জবানী থেকে জানতে পারি ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে মোহাম্মদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল শহীদ সলিমুল্লাহ সাহেবের তাজমহল রোডস্থ বাসভবনে ।
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানিদের হাতে বিশিষ্ট সমাজসেবী সলিমুল্লাহ সাহেব নৃশংসভাবে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে মোহাম্মদপুরে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আলোচনা সভায় মাওলানা আমীমী উপস্থিত ছিলেন। তাঁর একাত্তরের স্মৃতিচারনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শাকের হোসাইন শিবলি কর্তৃক সম্পাদিত ‘একাত্তরের চেপে রাখা ইতিহাস, আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ গ্রন্থে।
ব্যক্তিজীবনে নিভৃতচারী ও পরপোকারী মাওলানা আমীমী ধর্ম চর্চা ও গ্রন্থপাঠে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। জ্ঞান অন্বেষার প্রতি তাঁর ছিল সীমাহীন আগ্রহ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থানরত তাঁর একমাত্র ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়েও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন আমেরিকার পথে প্রান্তরে ঘুড়ে বেড়ানোর স্মৃতি। তাঁর পরমতসহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদারমনস্ক চিন্তা-চেতনা সহজেই যে কাউকে আকৃষ্ট করতো। প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাযের পূর্বে তাঁর দেওয়া বাংলা খুৎবা ছিল কোরআন ও হাদীসের আলোকে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, যা শুনে নামাযীরা বিশেষভাবে উপকৃত হতেন এবং ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা পেতেন। অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা তিনি সবসময় পরিহার করতেন। চেনা অচেনা, ছোট-বড় সকল পথচারী ও দর্শনার্থীদের দেখা হওয়া মাত্র তিনি প্রথমেই সালাম পেশ করতেন।
শিশুদের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম মমতা ও ভালোবাসা। ঢাকা রেসিডেনসিয়েল মডেল কলেজের জুনিয়র শাখার সকল শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন একান্ত আপনজন। তাঁর সুযোগ্য শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে স্বক্ষেত্রে সুনাম অর্জনের পাশাপাশি মাওলানা আমীমীর প্রদর্শিত মানবীয় গুনাবলীও ধারন করেছে তাদের সামগ্রিক জীবনযাপনে।
একজন অমায়িক, আদর্শিক, সদালাপী, নিঃস্বার্থ ও খোদাভীরু মানুষ হিসেব মাওলানা আমীমী ছিলেন অনুকরনীয় ও অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীকে মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট এই প্রার্থনা, তাঁকে করুনাময় জান্নাতে উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা দান করুন, আমীন।
লেখক: ব্যারিষ্টার আহমদ ইহসানুল কবীর, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।