ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
একটা ছবি, একদিকে শাড়ি পরা নারী, অন্যদিকে সালোয়ার কামিজ ও হিজাব পরা আরেক নারী। সামাজিকমাধ্যমে এমন ছবির নিচে একজন লিখলেন, শাড়ি পড়া দেখলেই বোঝা যায় এই আমাদের মূল, অন্যটা ধর্মীয়। পোশাকের মধ্যে নিজস্ব ঐতিহ্যের একটা পরিচয় থাকে এটা সত্যি। কিন্তু মুশকিলটা হয় তখন, যখন নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়।
পোশাক নিয়ে ইদানিং আমাদের অনেক কথা হচ্ছে। নরসিংদী রেল স্টেশনে জিন্স আর টপস পরার জন্য এক তরুণীকে হেনস্থা হতে হলো। এর আগে হিজাব নিয়ে হেনস্থার ঘটনা ঘটেছে। টিপকাণ্ড তো সবারই জানা। মানুষের পোশাক পরার স্বাধীনতা তার নিজের। সেখানে নীতি পুলিশিং হলো অপরাধ। কাপড় কেউ যদি না পরে, সেটা দৃষ্টিকটু। লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার জন্য, উন্মুক্ত করার জন্য নয়। সেক্ষেত্রে নীতি পুলিশিং প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু পোশাক পরার ব্যাপারে নীতি পুলিশিং হলো স্রেফ অনধিকার চর্চা। নরসিংদীর তরুণীর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। সেই মেয়ের বিরুদ্ধে অনধিকার চর্চা করা হয়েছে এবং তা শাস্তিযোগ্য।
ফটো দেখিয়ে একজনেরটা ঐতিহ্য, অন্যজনেরটা ধর্মীয় এমন বিভাজন করাটাও নীতি পুলিশিং এবং অনধিকার চর্চা। এই চর্চা সুশীলের আবরণে সুকৌশল বিভাজন। এই বিভাজনটা সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। হিজাবের বিরুদ্ধে যা হয়েছে, তা পোশাক পরার স্বাধীনতার পুরোটাকেই খর্ব করেছে। ওড়না বিষয়েও এদেশে যা হয়েছে তা রীতিমত অপরাধ। এমনকি পাঠ্যপুস্তকে ওড়না শব্দটি নিয়েও কম পানি ঘোলা করা হয়নি। অথচ যারা করেছেন তারা হয় জানেন না, না হয় ইচ্ছে করেই ঐতিহ্যের ইতিহাস আড়াল করে গেছেন।
বিষয়টি পরিষ্কার করতে প্রাচীন ভারতের দিকে তাকাই। দক্ষিণ ভারত তথা তামিলনারুতে স্তন আবৃত করার কথা তৎকালীন সাহিত্যে পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা রয়েছে। খোদ কালিদাসের রচনায় স্তন আবৃত্ত করা কাপড়ের কথা বলা হয়েছে। যা তিনি ‘কুরপাস’ নামে অভিহিত করেছেন। এখনো ওড়নাকে ‘স্তনপট্ট’ নামে ডাকা হয়। ওড়নাকে ‘আধখান’ হিসেবেও বলা হতো। অর্থাৎ স্তন ঢেকে রাখায় কাপড়ের ব্যবহার ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো। উত্তরিয় জিনিসটাও ওড়না। আদি সংস্কৃতি ও সাহিত্য তাই বলে। আদি সাহিত্যে কাঁধে রাখা কাপড়ের টুকরাকে বলা হতো উত্তরিয়, কাঁধের ওড়না। আমাদের দেশে যা ‘মহামহিম’দের প্রদান করা হয়। হিন্দির ‘দোপাট্টা’ তো ওড়নাই। অথচ সেই ওড়নাকেই এখন ভিন্ন সংস্কৃতি বলে বাতিল করা দেয়া হচ্ছে। আজব না?
হিজাব বিষয়ে কথা হয়। ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে মাথা ঢেকে রাখার প্রচলন ছিলো। যা এখনো ঘোমটা নামে টিকে আছে। প্রাচীনকালে মাথা ঢাকার জন্য ব্যবহার করা হতো আলাদা কাপড়ের টুকরো। যাকে বলা হতো ‘শিরবস্ত্র’। এখনো দক্ষিণ ভারতের বিবাহিত মহিলারা ওড়না ও হিজাবের কম্বিনেশকে ‘ঘুঙ্গাট’ নামে ব্যবহার করেন। প্রাচীন ভারতের অসংখ্য চিত্রকর্মে মাথা ও বুক ঢেকে রাখা কাপড়ের ব্যবহার দেখা গেছে। ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই প্রাচীন ভারতে মাথা ও বুক ঢাকার ব্যাপারটি প্রচলিত ছিলো। অর্থাৎ বুক ও মাথা ঢাকতে কাপড়ের ব্যবহার হতো, তা যে নামেই হোক।
কথা পরিষ্কার, যারা হিজাব বা ওড়নাকে ভিন্ন সংস্কৃতি বলে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রোপাগান্ডা চালাতে চান তারা হয় অজ্ঞ, নয় জ্ঞানপাপী। আর তাদের প্রচারণার ফলেই দক্ষিণ এশিয়াতে একটি বিভাজিত সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। এই বিভাজনের ভূত আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে সর্বক্ষণ। কেউ ওড়না আর হিজাবের পেছনে লেগে আছেন। যার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে নরসিংদী রেলস্টেশনে লাঞ্ছিত হচ্ছেন তরুণী ও তার বন্ধুরা। সৃষ্টি হচ্ছে টিপকাণ্ডের মতন ঘটনার।
শাড়ির বিষয়ে আসি। যারা ঐতিহ্য বলে গলা ফাটান, তারা কি জানেন, শাড়ি মূলত এই বঙ্গের পোশাক নয়। শাড়ি কেন এ বঙ্গের পোশাক নয়, তা ইতিহাসের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। প্রচলিত ঐতিহাসিক মত হলো, সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে আর্যরা শাড়ির প্রচলন করেন। আমরা যে বঙ্গে বাস করি তা মূলত দ্রাবিঢ় ভূমি। আর্যরা এই বঙ্গে সুবিধা করতে পারেনি। তাই শাড়ির উৎপত্তি এই বঙ্গে নয় এটা পরিষ্কার। শাড়ি মূলত দক্ষিণ ভারত থেকে ধার করা। তবে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা সেলাই বিহীন এই কাপড়ের ব্যবহার এই বঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই শুরু হয়েছিলো। অবশ্য এক্ষেত্রেও আমাদের তথাকথিত পণ্ডিতদের জন্য খারাপ খবর রয়েছে। সে সময়ে এই বঙ্গে শাড়ির সাথে ওড়না পরিধানেরও প্রচলন ছিলো। ‘আধখান’ বা ‘আধখানা’ শব্দটি ওই সময়েরই। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়কে সাক্ষী মেনেই বলি, সে সময়ে উচ্চবংশীয় রমণীরা স্তন ঢেকে রাখতে শাড়ির উপর ওড়না তথা ‘আধখানা’ পরতেন।
সুতরাং পোশাক নিয়ে যে বিভাজনের শুরু এ দেশে হয়েছিলো এবং যা এখনো চলমান যার শুরু করেছিলেন তথাকথিত ঐতিহ্য সন্ধানীরা তা মূলত অর্থহীন। অকাজের। এ শুধু ঘৃণা আর বিভেদই বাড়িয়েছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। বিষবৃক্ষ রোপণ করলে, তার ফলে অমৃত আশা করাটাকে আপাত বোকামো বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত আলাপে এটা বোকামো নয়, বুদ্ধিমত্তার প্রকাশও নয়, এটা ধূর্ততা। আর ধূর্ততা বরাবরই ক্ষতিকর এবং তা সবার জন্যই।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।