ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
‘শুদ্ধতার দারোয়ান’দের মামলার ভয়ে হিরো আলম বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইনি, ‘ওটা অফিসিয়াল না।’ ভাই, মানুষকে আপনারা মনের আনন্দে গানও গাইতে দেবেন না। কদিন আগে প্রায় ‘মন খারাপ’ বলা নিষিদ্ধ করে ফেলেছিলেন। এখন কি আনন্দ প্রকাশও নিষিদ্ধ! আপনারা কি ভাই ‘মহান কিম’ কিংবা তার ভাই-ভগিনী’র অনুসারী?
কিম ও তার ভাই ভগিনীদের সেই অনুসারীদের প্রশ্ন করি, কখনো রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুনেছেন? একজন রিকশাওয়ালা কিংবা দিনমজুর বামপন্থীদের ভাষায় যারা ‘প্রলেতারিয়েত’ তারা কাজের সময় মনের আনন্দে বাউল, ভাটিয়ালি এমন কী ব্যান্ড সাথে হিন্দিও গায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গায় না।
কেন গায় না? লেখক মঈনুল আহসান সাবের এর ভাষায় ‘শুদ্ধতার দারোয়ান’ যারা, তাদের ভয়ে গায় না। কখন আবার সুর, তাল, লয় এবং ভাষা যা আবার প্রমিত কিনা তাই নিয়ে খুঁত ধরে ফেলেন। তাদের অন্যক্ষেত্রে নুয়ে পড়া অনুভূতি এক্ষেত্রে জাগ্রত হয়। বলে বসেন, ‘মোর চাচায় চকিদার, মুই কিন্তু আইনের লোক’। বাউল বা ভাটিয়ালি বা অন্যক্ষেত্রে সে ভয়টা নেই।
এরা মূলত রবীন্দ্রনাথকে দেবতা বানিয়ে ফেলেছে, গানকে ধর্মসঙ্গীত। যা অচ্ছুতদের জন্য হারাম। বলতে পারেন একটা ‘কাল্ট’ গড়ে তুলেছে। এটা হালাল শুধু ‘শুদ্ধাচারী’ গাড়িওয়ালাদের জন্য। প্লেজার ট্রিপে লং মতান্তরে রং ড্রাইভের জন্য। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ‘প্রলেতারিয়েত’দের নন। ভূঁইফোড় ‘শুদ্ধতার দারোয়ান’দের। কথিত এলিটদের।
না, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, শুদ্ধতার এসব দারোয়ানদের দেখা মেলে হালসময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সাহিত্যের অবস্থা তো ভয়াবহ। বাংলাদেশের প্রধানতম কবি আল মাহমুদকে প্রায় নিষিদ্ধই করে ফেলেছিলো এই শুদ্ধাচার বাহিনী। টেড হিউজ প্রেমিকা ও স্ত্রী’র আত্মহত্যার প্ররোচনা কিংবা হত্যার মতন অভিযোগ কাঁধে নিয়েই ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তার কাব্যকে কেউ অস্বীকার করেনি। সাহিত্যকে ব্যক্তির থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে সব ‘উল্টো বুঝলিরে রাম’ অবস্থা। ব্যক্তি ও তার কর্মকে এক করে ফেলা হয় এখানে। এখন নিজের মতকে সবাই ধর্মমত বানিয়ে ফেলেছে। সেই মতের সাথে না মিললেই অন্যর অস্পৃশ্য, অচ্ছ্যুৎ।
বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পিয়াস করিম এর দেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কারণ তার সাথে মতের মিল নেই। অথচ যে দোষে পিয়াস করিমদের দুষ্ট করা হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি দোষের ভাগীদারদের নিয়ে চলে শোকের নামে মচ্ছব।
সবকিছুতেই গড়ে উঠেছে আত্মবিনাশী ‘কাল্ট’ প্রথা। অন্ধ অনুকরণ চলছে গুরুর বচনের। অথচ এই অন্ধরাই অন্যকে পথ দেখাতে চায়। এই প্রথার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের রোদ্দুর রায় এক শক্ত প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদের অংশীদার হয়েছেন হিরো আলম এবং তা না বুঝেই। নাড়িয়ে দিয়েছেন ‘কাল্ট’ এর অস্তিত্বকে। ভয় পেয়ে গেছে তারা। যার ফলেই তাদের চাচা যে চকিদার এবং তারা আইনের লোক তা প্রমাণ করতে অস্থির হয়ে উঠেছে।
কী ঠুনকো এই সেই ‘কাল্ট’ এর বুনিয়াদ! অনেকটা কাচের ঘরের মতন। এক হিরো আলমেই যা ভেঙে পড়ার দশা। যারা রবীন্দ্রনাথকে কাল্ট প্রধান বানিয়েছেন সত্যিকার অর্থেই যদি তাদের বিরুদ্ধে সঠিক প্রতিবাদ হয় তাহলে কী হবে? না, এত ভাবনার দরকার নেই। এমন প্রশ্নের এক কথার উত্তর হলো, তারা হবে ‘রাজাপাকসে’।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।