• ০৯ জুন ২০২২ ১১:১৪:০০
  • ০৯ জুন ২০২২ ১১:১৪:০০
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের আগুন জাজ্বল্যমান হতাশার প্রস্তুতিহীন দৃশ্যচিত্র

ছবি : সংগৃহীত

কাকন রেজা: 

চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপোর আগুন নিয়ে নানা কথা হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু প্রাথমিক যে কথা, সে কথাটাই অনেক এড়িয়ে যাচ্ছেন কিংবা ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মৃত হয়েছেন। এই যে গণমাধ্যম লিখছে, ‘একের পর এক আসছে লাশ’, এসব লাশের মধ্যে শুধু সাধারণ মানুষই নয় রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও। যখন লিখছি তখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি আগুন। ষোল ঘন্টা ধরে জ্বলা এই নিয়ন্ত্রণহীন আগুন কেন নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। 

রাসায়নিকের আগুন পানিতে নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব কিনা সেও এই প্রশ্নের বড় একটা অংশ। বিশ্বের যে কোনো স্থানে এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সাধারণত হেলিকপ্টার বা বিমান ব্যবহার করা হয়। আকাশ থেকে পানি প্রয়োজনে ফোম ছিটানোর ফলে নিয়ন্ত্রিত হয় আগুন। কিন্তু এতবড় একটা ঘটনায় এমন কোনো দৃশ্য চোখে পড়েছে কি কারো? ছাব্বিশ একরের বিশাল জায়গা জুড়ে একটা ডিপোতে ষোল ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলছে, তা নেভানোর চেষ্টা চলছে শুধুমাত্র সনাতনী পানি পদ্ধতিতে! অসম্ভবের সেই চেষ্টায় মারা পড়ছেন ফায়ার ফাইটারেরাও, কি নিদারুণ না?

প্রথম আলো আগুন নেভানোর প্রক্রিয়া বিষয়ক খবরের শিরোনাম করেছে, ‘যেভাবে চলছে আগুন নেভানোর চেষ্টা’। সেই খবরে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালকের ভাষ্য হচ্ছে, তাদের আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলের কাছে গিয়ে পানি ছিটাতে পারছে না। বাধ্য হয়েই সেনাবাহিনীকে হাত লাগাতে হয়েছে। বিপদের শেষ ভরসা। এই কথার বিপরীতে প্রশ্ন হলো পানি দিয়ে কি সব আগুন নেভানো সম্ভব হয়? বিশেষ করে রাসায়নিক থেকে যে আগুনের উৎপত্তি। কিছু রাসায়নিক পানির সংস্পর্শে আরো দাহ্য হয়ে উঠে। উপপরিচালক বলছেন, আগুনের কাছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছাতে পারছেন না। মাটি থেকে পৌঁছানো সম্ভব না হলেও আকাশপথে অসম্ভব নয়। কিন্তু আকাশ থেকে আগুন নেভানোর প্রস্তুতি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমাদের ফায়ার সার্ভিসের রয়েছে কিনা সেটাও জিজ্ঞাস্য। আমাদের উন্নয়নের বাগাড়ম্বর যে এই ভয়াবহতার সমুখে কতটা ঠুনকো চট্টগ্রামের এই আগুন খুব ভালোভাবে জানিয়ে দিলো। করোনাতেও দেখেছি আমাদের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এর অবস্থা। অনেক হাসপাতালে অক্সিজেন পর্যন্ত ছিলো না। অক্সিজেনের জন্য মানুষের আহাজারি দেখেছি কাগজের পাতায় ও টিভির পর্দায়। কালকেও সে চিত্র দেখেছি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। দেখেছি অক্সিজেনের গাড়ি পৌঁছানোর দৃশ্য। একটা বিভাগীয় প্রধান হাসপাতালের বড় একটা ম্যাসাকার সামাল দেয়ার সামগ্রিক ক্ষমতা নেই, এটাই সেই দৃশ্যের বাস্তবতা। 

কী রাসায়নিক এবং সেই রাসায়ানিকের আগুনের প্রকৃতি কী হতে পারে, তা কি বিস্ফোরকে পরিণত হতে পারে, এসবের কিছুই আমাদের সঠিক জানা নেই। খবরের মাধ্যমগুলো শুধু প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিকের কথা। এ সম্পর্কে আর বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এই রাসায়নিক কেন আনা হয়েছিলো, কারা এনেছিলেন, তারও সামান্যতম কোনো তথ্য নেই। তবে উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে নিরাপত্তাজনিত কারণে সবসময় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। আর এটা মূলত রকেটের জ্বালানির প্রপোল্যন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো এটাকে যদি উত্তপ্ত করা যায়, তাহলে এর আচরণ হতে পারে বিস্ফোরকের মতন। যা আমরা দেখেছি চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপোতে। এখন প্রশ্ন হলো কী কারণে এই বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি করা হলো এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই অন্যান্য কন্টেইনারের সাথে রাখা হলো। 

প্রথম আলো’র খবর অনুযায়ী আগুনের ফলে উত্তাপ ও ধোঁয়া ছড়িয়েছে আড়াই কিলোমিটার এলাকায়। রাতেই গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বিস্ফোরণে চার বর্গকিলোমিটার জায়গার অনেক বাড়িঘরেরই জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে। সুতরাং এটাকে শুধুমাত্র সামান্য দুর্ঘটনা হিসেবে বলার আর অবকাশ নেই। আমি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মৃত্যু, আরো মৃত্যুর সম্ভাবনা সাথে কয়েকশ মানুষের আহত হওয়াকে দুর্ঘটনার নামে ছোট করে দেখারও কোনো উপায় নেই। এটা একটা ট্র্যাজেডি এবং তা ভয়াবহ। অথচ যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিলো আমাদের, মানুষের সহমর্মিতারও কোনো অভাব ছিলো না। শুধু অভাব ছিলো প্রযুক্তির আর দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছার। অবশ্য কথা এখানেই শেষ নয়। রাসায়নিক থেকে আগুন এবং তার পরিবেশগত প্রভাব আশেপাশের প্রকৃতি ও মানুষের উপর কীভাবে পড়বে তাও ভেবে দেখার বিষয়। রাসায়নিকের তেজস্ক্রিয়তার ব্যাপারটা নজরআন্দাজ হবে আরেকটা বড় বোকামো। 

আমাদের কাছে আগুনের ঘটনা নতুন নয়, তাজরীন ফ্যাশন থেকে নিমতলী, আমাদের স্মৃতিতে এখনো জাজ্বল্যমান। কিন্তু তারপরেও আমাদের প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। নিমতলীর আগুনের পরও আমাদের রাসায়নিক থেকে আগুন নির্বাপনে সেই সনাতন পানি পদ্ধতির উপরই ভরসা ও ব্যবহার করতে হচ্ছে। অর্থাৎ অবস্থা যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই। অথচ স্যাটেলাইটের চেয়ে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন আমাদের জন্য সম্ভবত বেশি জরুরি ছিলো। তাজরীন বা নিমতলীর আগুন চট্টগ্রাম কন্টেইনার ডিপোর তুলনায় ছিলো ট্রেলার। হয়তো চট্টগ্রামের আগুনও এর মূল দৃশ্যচিত্র নয়। আমাদের পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে, আল্লাহ না করুন, সেখানে এমন দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের অবস্থা কী দাড়াবে? আমাদের প্রযুক্তিগত প্রস্তুতিহীনতার এই দৃশ্য মাথায় রেখে সেই চিন্তাটা করুন। দেখবেন, ‘আল্লাহ ভরসা’ ছাড়া আর কোনো শব্দ আপনার জিহ্বা জোগান দিবে না। 

কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক। 

সংশ্লিষ্ট বিষয়

চট্টগ্রাম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1444 seconds.