ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক তরুণীর জামা ছিড়ে নিয়েছেন এক মোটরসাইকেল আরোহী। বিপর্যস্ত তরুণী সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, তার ছেড়া জামাটাই বর্তমান বাংলাদেশ। না, এই ঘটনায় শাহবাগে মানববন্ধন হয়নি। দুর্বৃত্ত বা দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের দাবিও ওঠেনি। কিন্তু যদি সেই মোটরসাইকেল আরোহীর মাথায় হেলমেট না থেকে টুপি থাকতো তাহলে কিন্তু সেই নরসিংদী রেলস্টেশনের মতন প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যেত।
বিপর্যস্ত ওই তরুণী যে কিনা একটি রেডিও এর কর্মী, অর্থাৎ গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত, তার সাথে গলা মিলিয়ে আরেকটু যোগ করতে চাই, বর্তমান বাংলাদেশ সিলেক্টিভ প্রতিবাদের দেশ। এখানে এক শ্রেণির আঁতেলের সুবিধাবাদী প্রতিবাদের ফলে সব অর্জন জলাঞ্জলি যায়। আর সুবিধাবাদীরা তেলাঞ্জলির মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নেন।
বলতে পারেন প্রত্যক্ষ সেক্যুলার, পরোক্ষ সাম্প্রদায়িক কিছু মানুষ সৃষ্টি করেছে এই ইসলাম ফোব।
সুবিধাবাদীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ইসলাম ফোবিয়া। সারাবিশ্ব যখন উপলব্ধি করছে, ইসলাম ফোবিয়া মূলত তৈরি করা। বলতে পারেন প্রত্যক্ষ সেক্যুলার, পরোক্ষ সাম্প্রদায়িক কিছু মানুষ সৃষ্টি করেছে এই ইসলাম ফোব। কথিত সেক্যুলার এক্সট্রিমিস্টদের ল্যাবে তৈরি হয়ে হয়েছে ইসলামিক এক্সট্রিমিস্ট। তাদের মূলটা আসলেই একই। দেখুন নরসিংদী রেলস্টেশনের ঘটনায় যারা প্রতিবাদী হয়ে যেমন খুশি তেমন সাজোতে সামিল হয়েছিলেন, তাদের কিন্তু রা’টি নেই সেই রেডিওকর্মীর লাঞ্চিত হওয়াতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন একটি জায়গায় নিশ্চয়ই ইসলামিস্টরা কারো জামা ছিড়তে আসেনি। তাহলে কারা এসেছে, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখবেন উভয় এক্সট্রিমিস্টদের মূল জায়গা একটাই।
সম্প্রতি ইসলামের নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর বিয়ে নিয়ে কথা বললেন বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মা। রাসুল কত বছরের মেয়েকে বিয়ে করেছেন এটা নিয়ে তার আপত্তি এবং কটুক্তি। এটা স্রেফ ইসলাম বিদ্বেষ। সামাজিকমাধ্যমে একটা লেখা ঘুরছে। সে লেখায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যাকে একটা শ্রেণি নারীমুক্তির আলোকবর্তিকা বলেন। তিনিও নাবালক অবস্থায় নাবালিকাকে বিয়ে করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ সবার স্ত্রীর বয়সের হিসেবে সে লেখায় দেয়া রয়েছে। সে লেখা সত্যি না মিথ্যে তা নিয়ে এখনো কাউকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। না, আমার তাদের কনের বয়স দেখা কাজ নয়। আমার দেখিয়ে দেয়া ইসলাম বিদ্বেষের জায়গাটা। যেটা ইচ্ছাকৃত এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টির জন্য। আমরা আছি দুই হাজার বাইশ সালে। এখনের সাথে তুলনায় পনেরো’শ বছর আগের সামাজিক অবস্থা কী ছিলো, সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? দেখিনি।
যে সময় মেয়েদের জন্মের পরেই হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। আইয়ামে জাহেলিয়া বলা হতো যে যুগকে। যে যুগ অন্ধকারের যুগ। সে সময় কনের বিয়ের বয়স নিয়ে যারা আলোচনা করেন তারা হয় মূর্খ নয় জ্ঞানপাপী। তারা পনেরোশ বছর আগের কথা বলেন, কিন্তু ইশ্বরচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথের সময়ের কথা বলেন না। তখন তো সমাজ সেই পনেরো’শ সাল আগের চেয়ে এগুনো ছিলো। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সে সময়েও সংস্কৃতির বড়াই করেছে। কিন্তু সেই বড়াইয়ের ফলাফল কী? ফলাফল হলো বঙ্কিমচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন স্রেফ একটা শিশুকে। যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ভয়াবহ রকম সাম্প্রদায়িক। সুতরাং কথা বলার আগে অতীত জেনে বলা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলি। বৃহস্পতিবারও গান শুটিংয়ের ঘটনা ঘটেছে সেখানে। মারা গেছেন তিন জন। গত দু’মাসের গান শুটিংয়ে অন্তত ২৫ জন মানুষ মারা গিয়েছেন সেখানে, যাদের কেউই মুসলমানদের হাতে নিহত হননি। স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা কোনকিছুই গান শুটিং থেকে বাদ যায়নি। কিন্তু এর সাথে ইসলামকে কেউ জড়াতে পারেননি। অথচ একসময় ছিলো, একটা ঘটনা ঘটলেই তার সাথে ইসলামের নাম জড়িয়ে দেয়া হতো। অন্যরা করলে বলা হতো মানসিক বিকার আর মুসলিমদের নাম এলেই তা হয়ে যেত এক্সট্রিমিজম। এ ধারণা থেকে পশ্চিমী বিশ্ব পরিষ্কার ভাবে বেরিয়ে এসেছে। তারা বুঝতে পেরেছে এ এক্সট্রিমিজম সৃষ্ট এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এখন যেমন বর্ণবাদ, হোয়াইট সুপ্রেমেসি বলে যাকে আখ্যায়িত করা হয়, সেটাও রাজনৈতিক। সব সন্ত্রাসের পেছনেই রাজনীতি। সে হোক ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীগত। এ কথা আমরা বারবার বলার চেষ্টা করে এসেছি, কিন্তু ওই যে কানে দিয়েছি তুলো। যারা শোনার তাদের কাজ সিলেক্টিভ। তাদের কানে তুলো। তারা সুর ধরেছেন ‘শুনছি না, শুনবো না’র তালে।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।