ছবি : সংগৃহীত
কাকন রেজা :
ঢাকার সাভারে একজন শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এবং মেরেছে তারই শিক্ষার্থী। কী ভয়াবহ একটা সমাজ গঠন করেছি আমরা। যাকে বলে আদিম অ্যামাজনের ক্যানিবাল সোসাইটি। যেখানে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে মেরে ফেলার মতন চিন্তা পোষণ করে। অনেকে বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বলেই সেই শিক্ষককে হত্যার সাহস পেয়েছে ওই শিক্ষার্থী। এই চিন্তা ভয়াবহ একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা। এই চিন্তা সমস্যার সমাধান না করে বরং আরো বাড়াবে। সমাধানের রাস্তা আরো জটিল করে তুলবে।
হিন্দু মুসলমান নয়, দ্বন্দ্বটা হচ্ছে সবল আর দুর্বলের। উনি ছিলেন দুর্বল মানুষ। তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছিলো না, নেই। কর্পোরেট দুর্বৃত্ত নেই। সামাজিক সুবিধাবাদী নেই। তাই তিনি দুর্বল। এমন দুর্বল অসংখ্য মুসলিম আছেন যাদের শক্তিমানরা হত্যা করেছে। পিটিয়ে এমনকি পুড়িয়ে মেরেছে। কদিন আগে সীতাকুণ্ডের আগুনের কথা ভুলে গেছেন অনেকে। গোল্ডফিস মেমোরি বলে কথা।
মালিকপক্ষের মুনাফার বলি হলো কতগুলো দুর্বল মানুষ। মৃত কিংবা আহত হওয়াই শুধু নয়, মামলাও হলো উল্টো তাদেরই বিরুদ্ধে। ক্ষমতাবান মালিকের টিকিটিও ছোঁয়া গেলো না। কই এখানে তো হিন্দু মুসলিম বিভেদ ছিলো না, তবু শক্তিমানদের নির্মমতার আগুনে পুড়তে হলো দুর্বল মানুষদের। সাওতাল পল্লীর আগুনের কথাও হয়তো মনে নেই কারো। সেখানেও ধর্ম ছিলো না। ছিলো সবল আর দুর্বলের সংঘাত।
আজকে যারা শুধু ধর্ম দিয়ে এই সবল ও দুর্বলের পার্থক্যটা ঢাকতে চাচ্ছেন তাদেরও উদ্দেশ্য আছে। আর সেই উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ নয়। মনে আছে রাতের বেলায় ঢাকার রাস্তায় মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে মানুষ চাপা দেয়ার কথা। দিয়ে সোজা হেঁটে বাড়ি যাওয়া সেই শক্তিমান মানুষের কুপুত্রের কথা। সেখানেও তো কোনো ধর্মের বিভাজন ছিলো না। ভুলে গেছেন প্রায় সবাই। আমাদের দেশে মৃত্যু এত সহজ যে একমাত্র মৃত্যুকেই সহজেই ভুলে যাওয়া যায়।
অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যাতে অনায়াসে প্রমাণ করা যায়, ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী বলে কিছু নেই, রয়েছে দুটি শ্রেণি সবল আর দুর্বল। যারা এখানে ধর্ম টেনে আনেন তাদের কথা আগেই বলেছি, তাদের উদ্দেশ্য আছে। তারা ধর্মের চাদরে অন্য ঘটনাগুলোকে ঢেকে দিতে চান। দুর্বল মানুষদের উপর চলা অত্যাচারের সার্বিকতাকে আড়াল করতে চান সাম্প্রদায়িকতা নামের স্মোক স্ক্রিন দিয়ে। বানাতে চান বহুল চর্চিত ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা।
একজন শিক্ষককে গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে। ঘটনাটি নড়াইলের। তিনিও হিন্দু শিক্ষক। এখানেও কোনো ধর্ম নেই রয়েছে চেয়ার দখলের রাজনীতি। নারায়ণগঞ্জের শ্যামল স্যারের কথাও বিস্মৃত হয়েছেন অনেকে। নড়াইলের যাকে জুতার মালা পরানো হয়েছে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। সেই অধ্যক্ষের চেয়ার দখলের প্রচেষ্টা হলো ধর্ম অবমাননার অজুহাত। তিনি হিন্দু বলেই এই ফাঁদে ফাঁসানো সহজ হয়েছে। হিন্দু না হলে কী হতো। এরচেয়েও সহজে ফাঁসানো যেতো। নারী কেলেঙ্কারী তার একটা সহজ রাস্তা। যেটা ধর্ম অবমাননার চেয়েও সহজে করা যায়। ধর্ম অবমাননার ফাঁদ পাতার বিপদও রয়েছে। অনেক সময় উল্টো তা বুমেরাং হতে পারে। যেমন এ নিয়ে খোদ আমিই লিখছি। কিন্তু নারীর বিষয়টি খুবই সহজ। আর এই সহজকে আরো সহজ করে দিয়েছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের নামে আইনটির কিছু অংশ। এছাড়াও ফাঁসানোর আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে। ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর কাহিনী তো সবারই জানা। সুতরাং ধর্মই একমাত্র কারণ নয়। ধর্ম অনেক কারণের মধ্যে একটি। কারন সৃষ্টির কার্য হচ্ছে বাণিজ্য। রাজনীতি আজকাল সেই বাণিজ্যেরই অংশ। আজকাল রাজনৈতিক বণিকরাই সবচেয়ে ক্ষমতাবান।
সুতরাং দুর্বলের উপর এসব অত্যাচার থামাতে হলে সংখ্যালঘু-গুরু আলাপ দিয়ে কাজ হবে না। করতে হবে দুর্বল আর সবলের আলাপ। সব পরিচয় বাদ দিয়ে শুধু দুর্বল পরিচয়ে সবাই মিললে তবেই ক্ষমতাবান সেই সবল দুর্বৃত্তদের রোখা সম্ভব। আর না হলে, ওই শাহবাগের মোড়ে ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ হবে না। হবার কথা নয়।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।