ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
শুদ্ধাচারের নামে সাংস্কৃতিক এক্সট্রিমিজমের উত্থান ঘটেছে ভয়াবহ ভাবে। যা ধর্মীয় এক্সট্রিমিজমকেও ছাড়িয়ে যেতে বসেছে। ধর্মীয় শুদ্ধাচারবাদের নামে যে এক্সট্রিমিজম তাতে অশুদ্ধদের জন্য বরাদ্দ হলো অ্যাসাসিনেশন এবং তা শারীরিক। আর সাংস্কৃতিক এক্সট্রিমিজমের অ্যাসাসিনেশন সামাজিক। একটা মানুষকে শারীরিকভাবে মেরে ফেলে, আরেকটা সামাজিকভাবে। শারীরিক মৃত্যু অনেক সময় শাপে বর হয়ে ওঠে। কিন্তু সামাজিক মৃত্যু প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত ভোগায়।
হিরো আলমের মুচলেকা প্রসঙ্গে বিশুদ্ধতাবাদীদের না-না কথা শুনছি এবং তার প্রায় সবই দ্বান্দ্বিক এবং সাথে হাস্যকরও। কেউ কেউ বিকৃতি রোধে হিরো আলমের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপকে জরুরি মনে করেন। তাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কল্যাণ বলেও আখ্যা দেন। মূলত সমাজ আর কল্যাণের ভুল কনসেপ্টের জন্যই এমনটা বলেন তারা। এদের কেউ কেউ নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবী করেন। কারো কারো মোটা-তাজা গ্রন্থও রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো, সাক্ষর ও শিক্ষিতের পার্থক্যটাই তাদের বোধে নেই। গণমাধ্যমে দেখলাম নিজ গবেষণাপত্রের শিরোনামের ইংরেজি করতে পারেন না, তাকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সাক্ষরদের অবস্থা এই হয়। গবেষণা বিষয়ক চুরির না-না ঘটনা তো আমাদের জানাই।
বিশুদ্ধতাবাদী। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। এমন ‘বাদ’ হলো বাদ মানে বাতিল থেকে নেয়া। রবীন্দ্রনাথ কি বিশুদ্ধ ছিলেন? তার বিরুদ্ধেও অন্যর কাব্য, গানের সুর হাপিশ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। গগণ হরকরার উদাহরণটা এ ব্যাপারে অনেকেই দেন। আমি কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি করি না, উচিত নয় বলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে যারা ঋষি বানাতে চান, তাদের বলি, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথও বিশুদ্ধ ছিলেন না এবং নিজেকে কখনো বিশুদ্ধতাবাদী বলেও দাবী করেননি। কিন্তু তার আশেকানরা তা করেন। তারা রবীন্দ্রনাথকে ভগবান রজনীশ বানিয়ে ছেড়েছেন। বেঁচে থাকলে হয়তো রবীন্দ্রনাথকে এ লজ্জাতেই আত্মহত্যা করতে হতো।
বিশুদ্ধবাদীদের দ্বিচারিতার কথা বলি। এরা সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার কথা বলেন, কিন্তু কেউ যদি বিকিনি পরে সমালোচিত হন, সেই সমালোচকদের তারা ধুয়ে দেন। তখন তাদের উপর ব্যক্তি স্বাধীনতার ‘ভর’ হয়। জরায়ুর স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রগলভ হন বিপরীতে হাজার বছরের সংস্কৃতির ফেনা তোলেন। এদেশের বিশুদ্ধ সংস্কৃতি কি জরায়ুর স্বাধীনতার কথা বলে? বলে না। সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতা বলে ‘অসূর্যম্পশ্যা’র কথা। তারা বটতলায় বর্ষবরণ করেন, আবার থার্টি ফার্স্ট নাইটে খুশিজলের সাথে খুশি মনে খুল্লামখুল্লা নাচকেও সমর্থন করেন এবং সুযোগ পেলে নেচেও ফেলেন। বিখ্যাত অধ্যাপকের কারো কারো তেমন নাচের ক্লিপও অন্তর্জালে রয়েছে। এরা মূলত তামাক আর ‘দুদু’ দুটোই খেতে চান। যারা এ ধরণের শুদ্ধচারের কথা বলেন, বিশুদ্ধতাবাদের আলাপ তোলেন, তাদের মতন অশুদ্ধচারী কমই দৃষ্টিগোচর হয়।
ইনারা উত্তর কোরিয়ার কিমের মতন বিশুদ্ধতাবাদী। কিমের রাজত্বে দক্ষিণ কোরিয়ার গান ও সিনেমা দেখাও নিষিদ্ধ। এর জন্য সেখানে অনেক মানুষকে বিচারের নামে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছে। সেই কিমও লাল পতাকার ধারক। যাতে তারকা চিহ্নও রয়েছে। নিজ বিচারে কিম প্রগতিশীল এবং বিশুদ্ধতাবাদী। আমাদের শুদ্ধাচার্যগণের মতন। তার স্তাবকরা তাকে মহান জ্ঞানীও বলেন।
অ্যামেরিকা প্রবাসী, সাংবাদিক ও লেখক রওশন হক সামাজিকমাধ্যমে এ বিষয়ে চমৎকার একটি প্রশ্ন সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হিরো আলম কি জাতীয় সঙ্গীতও গাইতে পারবে না, তার তো উচ্চারণ শুদ্ধ নয়?’ যেমন নয় অসম্ভবকে সম্ভব করা নায়ক অনন্ত জলিলেরও। অনন্ত জলিলের ক্ষেত্রে দোষ নেই। কারণ তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন, হিরো আলমের সেই সক্ষমতা নেই। রওশন হকের প্রশ্নটার রেশ ধরেই বলি, হিরো আলমকে তাহলে তো জাতীয় সঙ্গীত গাইতেও নিষেধ করে দেয়া উচিত। একে তো রবীন্দ্রনাথের রচনা, তারোপর জাতীয় সঙ্গীত। এ ব্যাপারে কী বলেন, বিশুদ্ধতাবাদীগণ? দেশের শতকরা নব্বই ভাগের উপর মানুষ ‘বিশুদ্ধ’ প্রমিত উচ্চারণ পারেন না, তবে কি তাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইবার অধিকার নেই, কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীত? প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া হয়তো যাবে, কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না।
শুদ্ধাচারের নামে এই যে সাংস্কৃতিক এক্সট্রিমিজম শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। না হওয়ার বিকল্প নেই। নব্বই ভাগ মানুষের বিরুদ্ধে এদের অবস্থান। এরা একটা এলিট শ্রেণি গড়তে চাইছে, অনেকটা কানাডার বেগমপাড়া ধাঁচের। যেখানে শুধু প্রমিত উচ্চারণ যারা করতে পারবে তাদেরই জায়গা হবে। অন্যরা অচ্ছ্যুত। বর্ণাশ্রমের ধারণায় নমশূদ্র। সে অর্থে বিশুদ্ধতাবাদীদের রেসিস্টও বলতে পারেন। ফ্যাসিস্ট বললেও ভুল হবে না। কারণ তাদের ধারণায় তারাই শুধু সঠিক, আর সব বেঠিক।
এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই, যেমন নেই ধর্মীয় এক্সট্রিমিজমের বিরুদ্ধে। এদের উভয়ের লক্ষ্যই অ্যাসাসিনেশন। এরা মূলত কাল্ট গড়ে তুলেছে। তারা মানুষকে যেমন মারতেও পারে, তেমনি আত্মঘাতীও হতে পারে। ‘অর্ডার অব দ্য সোলার টেম্পল’ নামের কাল্টের কথা অনেকেই জানেন। যাদের বলা হয় খুন ও আত্মহত্যাপ্রবণ গোষ্ঠী। তাদের গুরু ছিলেন জোসেফ ডি মামব্রো। তার নির্দেশ অনুযায়ী তার অনুসারীরা মানুষকে হত্যা এবং নিজেরা আত্মহত্যা করতো। এক্সট্রিমিস্টরা এমনি অন্ধ।
এই যে অন্ধত্ব, তা থেকেই এদের বোধ-বুদ্ধি সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। এদের মস্তিষ্ক চিন্তা শক্তি হারায় বলেই, এমনটা করে। মানুষ ততক্ষণই মানুষ থাকে যতক্ষণ তার চিন্তা করার ক্ষমতা থাকে। মৃত্যু সেই চিন্তার ক্ষমতা কেড়ে নেয়, মানুষ স্রেফ একটা দেহে পরিণত হয়। খবরের মানুষেরা যেমন শিরোনামে লিখে, ‘অমুকের দেহ আজ দেশে আসছে’ তেমনি। চিন্তাহীন মানুষ শুধুই দেহ। সুতরাং বিশুদ্ধতাবাদের নামে যা হচ্ছে, তা মূলত চিন্তাহীনদের কাজ। আর চিন্তাহীনরা মূলত দেহ। চিন্তাহীনদের এই বিশুদ্ধতাবাদ মূলত মৃতদের বাদ, যা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা বলে। নিয়ন্ত্রিত এক দাস জীবনের কথা জানান দেয়।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।