ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
পুরোদমে যখন কোভিডের প্রকোপ চলছে দেশে, সেই ২০২০ সনে লিখেছিলাম। যে লেখা প্রকাশ পেয়েছিরো যুগান্তরের অনলাইনে। যুগান্তরে তখন কাকন রেজা’র কলাম নামে একটা কলাম ছিলো। সে লেখায় বলেছিলাম, দুর্নীতির টাকা উদ্ধার করে মানুষকে বাঁচানোর কাজে লাগানো উচিত। মাঝখানে আরো একটা বছরের বেশি সময় চলে গেছে। তখন শুধু স্বাস্থ্যখাতের বিপর্যয় চোখের সামনে ছিলো, এখন যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূরই বিপর্যয়। সেই বিপর্যয় কাটাতেই ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড সংক্ষেপে আইএমএফ এর কাছে ঋণ প্রার্থণা করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অনেক গণমাধ্যম যাকে ‘বেইল আউট’ বলছে। চাওয়া হয়েছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের সহায়তা। ঋণ বললাম না। কারণ, ‘বেইল আউট’ শব্দটার সাথে ঋণ যায় না। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ‘বেইল আউট’ নয় ঋণ চাওয়া হয়েছে। অবশ্য প্রথমে এই ঋণের ব্যাপারটিও অস্বীকার করা হয়েছিলো। পরে বিষয়টি খোলাসা করেছে খোদ আইএমএফ।
এখন কেন ‘বেইল আউট’ শব্দটি নিয়ে স্বীকার-অস্বীকার পর্ব তা বলি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, কিছুদিন আগে কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মূলধন সহায়তা চেয়েছিলো। তখন গণমাধ্যম ‘বেইল আউট’ শব্দটির ব্যবহার করে। অর্থাৎ দেউলিয়া হবার কিংবা সম্ভাবনার পরই ‘বেইল আউট’ প্রার্থণার বিষয়টি আসে। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ‘বেইল আউট’ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতেই ঋণ চাওয়া হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, ‘বেইল আউট’ শব্দটির ব্যবহার জাতিগত অপমানের শামিল।
মুশকিল হলো, প্রভাবশালী বৃটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বাংলাদেশের ঋণ চাওয়া নিয়ে মন্তব্য করেছিলো যা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘বেইল আউট আবেদনের পর আইএমএফ এর সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, এমনটা। পত্রিকাটি উল্লেখ করে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চাওয়া নব্বইটি দেশের মধ্যে মাত্র কয়েকটি দেশ ঋণ খেলাপি বা বিল পরিশোধে অপারগ হওয়ায় ‘বেল আউট’ চেয়েছে। অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য খবরের মাধ্যম, ব্লুমবার্গ এর একটি কলামেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘বেইল আউট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে ‘বেল আউট’ হোক আর যাই হোক, আইএমএফ এর কাছে ঋণ চাওয়া হয়েছে এটাই মূলকথা। আর আইএমএফ এর ঋণ হলো ‘কোরামিন’ টাইপ ব্যাপার। একেবারে শেষ চিকিৎসা। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে যেমনটি বলা হয়েছে, শেষ উপায় হিসেবে বিপর্যয় থেকে উত্তরণে আইএমএফ এর ঋণ ছাড়া কোনো উপায় নেই। শেষ উপায় মানে হলো, এর শর্ত অনেক। যা মানতে গেলে সরকার জনগণের কাছে অপ্রিয় হতে বাধ্য। যেমনটা দেখা গেছে আমাদের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। যদিও অনেকেই বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ঋণের কথাটা অজুহাত। মূলত পুরো বিপর্যয় থেকে বাঁচতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। দায়িত্বশীল তরফ থেকেও বলা হয়েছে, আইএমএফ ঋণের সাথে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই।
কতটা অপারগ হলে একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিজেকে অজনপ্রিয় করার ঝুঁকি নেয়, এটা বুঝতে ড্রোন বিজ্ঞানী হতে হয় না, হতে হয় না কলাবিজ্ঞানীও। গত কদিনে সামাজিকমাধ্যমে চোখ বুলালেই মানুষের ক্ষোভের ব্যাপারটি বোঝা সম্ভব। অবশ্য যারা অন্ধ কিংবা বধির তাদের ব্যাপার আলাদা। মজার ব্যাপার হলো, সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার যা ঋণ হিসেব প্রার্থণা করা হয়েছে তার বিপরীতে গত দু’বছরেই এর দ্বিগুন অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ধারণা আমার নয়, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের। অর্থাৎ গত এক দশকে যে পরিমান অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে, তা যদি দেশে থাকতো তাহলে ‘বেল আউট’ এর মত বিতর্কের মুখে পড়তে হতো না বাংলাদেশকে। চাইতে হতো না আইএমএফ এর ‘কোরামিন’ ঋণও।
টাকা পাচারের বিষয়টিও প্রথমে অস্বীকার করা হয়েছিলো। দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বলেছিলেন, টাকা পাচারের কথা অসত্য। এমনকি টাকা পাচারের অভিযোগ যারা করছেন, তাদের তা দেখিয়ে দিতেও বলা হয়েছিলো। এখন খোদ সেই দায়িত্বশীলরাই পাচারকৃত টাকা দেশে নিয়ে আসার জন্য না-না সুবিধা দেয়ার কথা বলছেন। নামমাত্র রাজস্ব প্রদানে সেই চুরিকৃত টাকাকে বৈধ করার কথা বলা হচ্ছে। একটা দেশে যখন চুরির মালকে জায়েয করা হয় এবং কাফফারার মাধ্যমে চোর ও চুরিকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা হয়, তখন বুদ্ধিমানদের বুঝতে বাকি থাকে না প্রকৃত চিত্রটা কী।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।