ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
পড়াশোনা করার জন্য যে দেশে গ্রেপ্তার হতে হয়, সে দেশে আর যাই হোক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করার আগে ভেবে দেখা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছেলে ভর্তি না হয়েই তিন বছর ধরে ক্লাশ করছে, এটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। পড়াশোনার ইচ্ছে পোষণ করা এবং চেষ্টা করা কি কোনো অপরাধ? ছেলেটি যদি মস্তানি করে বেড়াতো, ছিনতাই করতো সাথে বড় ভাইদের সহমত হতো তাহলে হয়তো কারো মাথাব্যথার কারণ হতো না। এমন অসংখ্য দৃশ্য চোখে পড়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বাইরের ছেলেরা এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের টিজ করে, ছিনতাই করে এবং ছিনতাইকারীদের হাতে খুনও হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। কাগজ খুলে দেখুন অনেক প্রমাণ রয়েছে। বিপরীতে এমন কাউকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার কয়টা প্রমাণ দেখাতে পারবেন। উল্টো তাদের তোষামোদ করার খবর রয়েছে গণমাধ্যমে।
একটা ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি, কিন্তু সে পড়ার আগ্রহে পড়ছে। ‘থ্রি ইডিয়টস’র আমির খানের মতন খানিকটা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ব্যর্থতা তার নয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থার। শিক্ষা মৌলিক অধিকার। সেক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতজন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর ক্ষমতা রাখে? সেই ক্ষমতা বাড়ছে না বরং কমানো হচ্ছে। শিক্ষকগণও সংখ্যায় যথেষ্ট। তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধাও একেবারে কম নয়। আর অ্যাস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষে থাকলে তো কথাই নেই। সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও গবেষণা কর্মে চুরির অভিযোগ ওঠে। ছাত্রীদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ তো ডালভাত। তাদের কিন্তু পুলিশে সোপর্দ করা হয়নি, নেয়া হয়েছে বিভাগীয় ব্যবস্থা। ছেলেটির জন্যও তা করা যেতো। তাকে ওয়ার্নিং দেয়া যেতো, ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করাও খুব সহজ ব্যাপার ছিলো।
একটা ছেলে এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করেও একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। আর পেলেও নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়ার অধিকার থাকে না। এক কিংবা আধা নম্বরের হেরফেরে তাকে নিতে হয় অপছন্দের বিষয়। ফলে যে আনন্দ নিয়ে সে পড়তে চেয়েছিলো তা বিষাদে পরিণত হয়। আনন্দহীন পড়াশোনা মূলত একাডেমিক গাধা তৈরি করে। এরা তখন বাধ্য হয়েই জ্ঞানার্জন বাদ দিয়ে অর্থোপার্জনের দিকে ঝুঁকে যায়। শুরু হয় অনৈতিক অর্থ রোজগারের অঘোষিত প্রতিযোগিতা। কানাডায় বেগমপাড়া হয়, সুইস ব্যাংকগুলো উপচে ওঠে। অপরদিকে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার বাধ্য হয়েই নিজের জায়গা-জমি বিক্রি করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্তানদের পড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাশ করার পর চাকরি জোটে না, ফলে আম-ছালা দুটোই যায়। এই যে চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা এবং দুর্নীতিবাজ একাডেমিক গাধা তৈরির দায় তা রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা এড়াতে পারে না। পারা উচিত নয়।
যে ছেলেটা ভর্তি না হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করেছে, ক্লাশের পরীক্ষাও দিয়েছে, তার লক্ষ্য ছিলো সম্ভবত জ্ঞানার্জন। কারণ, জানতো সে এখান থেকে কোনো ডিগ্রি হাসিল করতে পারবে না। আর যেখানে শিক্ষার চেয়ে সার্টিফিকেটের মূল্য বেশি, সেখানে জ্ঞানার্জন যে জীবিকার কোনো কাজে আসবে না তাও সে জানতো। তারপরেও সে জ্ঞানার্জনের জন্যই সেখানে গিয়েছে। একাডেমিক গাধা হতে চায়নি সে। তার এই ইচ্ছের প্রতি যখন সম্মান জানানোর কথা। যে ইচ্ছের কথা মোটিভেশনাল স্পিকারদের আলাপের বিষয় হওয়ার কথা, সেখানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনটা বোধহয় আমাদের দেশেই সম্ভব। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এ নিয়ে হয়তো লিখতেন, ‘এদেশে পড়াশোনা না করার জন্য কাউকে গ্রেপ্তার হতে হয়নি বরং পড়াশোনা করার জন্য গ্রেপ্তার হতে হয়েছে’। এ সময় হুমায়ূন আহমেদের বড় প্রয়োজন ছিলো। যিনি নামের আগে ডক্টর লিখতে পছন্দ করতেন না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট