ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
দেশ যখন চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, তখন একদল মেতেছেন পোশাক নিয়ে। গত এক যুগ ধরেই দেখে আসছি এই ডাইভার্শন প্রক্রিয়া। যখনই কোনো জাতীয় সমস্যা, যা মানুষের মৌলিক অধিকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা নিয়ে কথা ওঠে, তখনই এই ডাইভার্শন টুলগুলো সক্রিয় করা হয়। ধান ভানতে চলে শিবের গীত।
সামাজিকমাধ্যম থেকে গণমাধ্যম সবখানেই চলে এই ভূতের কেত্তন। শরীর ঢাকা না শরীর উন্মুক্ত, যেন এই প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে আমাদের অস্তিত্ব সংকট। এর সমাধান হলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে না। মানুষ তার জান ও জবানের স্বাধীনতা পাবে। পেট ভরে ভাত পাবে। সরকারি হাসপাতালে মিলবে চিকিৎসা। বাচ্চাদের শিক্ষা জীবন নিশ্চিত হবে। পাওয়া যাবে কাজের ন্যায্য মজুরি। সুতরাং প্রশ্নটা সঙ্গতই উঠে আসে, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার চেয়ে কি পোশাক বিতর্ক জরুরি?
এই যে বাবা-মা নিজের জান কয়লা করে বাচ্চাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, সেই বাচ্চারা কি চিন্তা করেন তাদের বাবা-মার সেই পরিশ্রমের কথা। যে টাকায় খেয়ে-পরে শরীর ঢাকা বা উন্মুক্ত করার প্রশ্নে আকুল তারা, সেই খরচ জোগাতে বাবা-মার কী করতে হয় তাকি জানে তারা? একটা রাষ্ট্র গড়ে উঠার কতগুলো ধাপ থাকে তারা জানে কি? তারা কি জানে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা নিশ্চিত হবার পর অন্য বিষয়গুলো উঠে আসে? না, তারা জানে না। তারা আছে নিজেদের সংস্কৃতিবান পরিচয়ের মোহে। তাদের বাবা-মার কী হলো, তাতে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না।
কৃষক কিংবা দিনমজুর পিতা নিজেদের একবেলার আহার কমিয়ে তাদের খরচ জোগাচ্ছে সে খবর তাদের জানা নেই। তারা জানে না চাল-ডাল-তেলের হালহকিকত। তাদের মা ছেঁড়া কাপড়ে শরীর ঢাকার কসরত করছেন তা তাদের অজানা। কারন তাদের টাকা পাঠানো তো কমেনি। বাবা-মা এক বেলা কম খেয়ে হলেও তাদের টাকার জোগান দিচ্ছেন। বাবা কাজের জায়গা থেকে খরচ বাঁচাতে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। এই বাবা-মাদের জন্য মায়া হয়। কদিন আগেই চা-শ্রমিকদের একশ বিশ টাকার বিপর্যস্ত জীবনের যে আলাপ হলো, তাও তাদের বোধের গভীরে আঘাত করতে পারেনি।
নিজেদের অতীত ইতিহাস না জেনে, সংস্কৃতি না জেনেই সংস্কৃতিবান হওয়ার চেষ্টা যে কতবড় মূর্খতা, তা বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। এই উপমহাদেশের পোশাক বৈচিত্র্য নিয়েও তাদের কোনো ধারণা নেই। ওই যে ‘কর্তায় কইছে’ অবস্থা আর কী। এরা মূলত অশুভ কাল্টের অধীন হয়ে পড়েছে। তাদের গুরুরা যা বলবেন, তাই সত্য। এর বাইরে কিছু নেই। অথচ এসব গুরুদের দৌড় কতটা তা যদি সত্যিই তারা বুঝতেন তাহলে গুরুদেবদের মুখ লুকাতে বনে যেতে হতো।
একটু জানিয়ে রাখি, এই যে সারা শরীর ঢেকে রাখার সংস্কৃতি, তা আরব থেকে আসেনি। এ দেশেই ছিলো। অসূর্যম্পশ্যা শব্দটি আরবের নয়। ঘুঙট অর্থাৎ মাথা মুখ ঢেকে রাখার সংস্কৃতি চলে আসছে এ মহাদেশে ইসলামের জন্মের আগে থেকেই। সারা শরীর ঢেকে রাখাও তাই। চুনারি বা দোপাট্টার প্রচলন হয়েছে এ উপমহাদেশে মুসলমানরা আসার আগেই। যারা এসবে অযথা ইসলাম তথা ধর্মকে টেনে আনেন তারা ইতিহাস ঘেটে দেখুন, নিজেরাই ঘেটে যাবেন।
এই যে যারা সংস্কৃতি নিয়ে মেতেছেন তারা সংস্কৃতির মূল উৎপত্তিটাই জানেন না। জানেন না সংস্কার থেকেই সংস্কৃতি। এই উপমহাদেশের প্রথম বস্ত্র হলো নেংটি। সেই নেংটি যুগ থেকে আজকে আমাদের এই অবস্থান। নেংটা থেকে সভ্য হওয়া তথা পোশাকের যে বিবর্তন তা মূলত সংস্কার। যারা সংস্কৃতি নিয়ে এত মাথা ঘামান, অতীতে ফিরতে চান, তারা যান না নেংটি যুগে ফিরে। মেয়েদের অসূর্যম্পশ্যা করে রাখুন।
শেষ কথা বলি, গোড়া না জেনে মাঝখান থেকে নাচানাচিটা বন্ধ করাটা জরুরি। তারচেয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার মূল জায়গাগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করুন। দেখুন, আপনি তিন বেলা তৃপ্তি সহকারে খেতে পারছেন কিনা। আপনার মাথা গোঁজার একটা নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে কিনা। আপনার সভ্য পোশাক পরার সামর্থ্য রয়েছে কিনা। আপনার চিকিৎসা ও শিক্ষা নিশ্চিত কিনা। পড়াশোনা শেষে চাকরি পাবেন কিনা। ঘর থেকে বেরুলে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা আছে কিনা। সর্বোপরি আপনি নিরাপদ কিনা। এসব না দেখে সংস্কৃতির আলাপ হলো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতন। এতে ঘোড়াও আগায় না, গাড়িও চলে না, স্থবির অবস্থা।
ফুটনোট : কারো কারো জন্য এই স্থবির অবস্থা খুব দরকারি। মানুষের চিন্তার অগ্রসরমানতা বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে তাদের টিকে থাকাটা মুশকিল। কিন্তু মানুষের বোধের জায়গাটাকে অপ্রয়োজনীয় চিন্তা দিয়ে স্থবির করে দেয়ার এই খেলাটা দেশ ও জাতির জন্য আত্মঘাতি।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।