ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
বাংলাদেশে কতিপয় মানুষের কাছে নারীবাদ মানেই কিছু লেখালেখি, ইসলাম বিদ্বেষ, আর নারীদিবসের র্যালি ও বক্তৃতামালা। এমনি একজনের লেখা পড়লাম, যিনি ভিন্ন চিন্তার মানুষদের বেওকুফ বলে লেখা শুরু করেছেন। বুদ্ধিজীবী দাবিদার ওই লোক আবার আইনজ্ঞও, আজব না! সেক্স স্লেভারি নিয়ে যখন মানুষ কথা বলছে। যৌন দাসত্বের এক বিভৎস রূপ যখন মানুষের বোধে আঘাত করছে, তখন এই চিন্তার মানুষেরা তাতে স্রেফ দু’পক্ষের কলহ দেখছেন। এমন চিন্তাকেই দার্শনিকতার সংজ্ঞায় ডগমাটিজম বলে। মতান্ধতা চোখ থাকতেও মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এই ডগমাটিক তথা মতান্ধরাই সিলেক্টিভ চিন্তা দিয়ে নারীর বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধকে শুধুমাত্র দলীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করছেন। এমন চিন্তার কারণেই এদেশে নারী নিগৃহ ক্রমেই স্বীকৃত রূপ নিচ্ছে।
সেক্স স্লেভারি সম্পর্কে এমন ডগামটিকরা যে ওয়াকিবহাল নন, তা বলবো না। অবশ্য ওয়াকিবহাল শব্দটি পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে না। ওই যে, বেশি পড়ে না বোঝা ও কম পড়ে বোঝার পার্থক্যের মতন। অর্থাৎ সে বেশি পড়েছে ঠিকই বিপরীতে বুঝেছে কম। ওয়াকিবহাল হলেও সেক্স স্লেভারি বিষয়টি তার বোধগম্য হয়নি। কিংবা হয়তো সেও স্লেভারিতে বিশ্বাস করে। বিড়াল যেমন বিশ্বাস করে খামচিতে। সেটাই তার স্বভাব। খামচিতে সে অস্বাভাবিকত্ব দেখে না।
আমাদের দেশের নারীবাদ সমালোচিত হচ্ছে আমাদের এমন নারীবাদীদের জন্য। সিলেক্টিভ নারীবাদীতা তাদের সমালোচনার মুখোমুখি করেছে। এই নারীবাদকে অ্যাসাইলাম সিকিংয়ের প্রতিরূপও বলা হয়। সফলও হয়েছেন অনেকে। অ্যাসাইলামে বিদেশে নিরাপদ জীবন-যাপন করছেন তারা। আর এদেশের নারীরা বরাবরের মতই অনিরাপদ রয়ে গেছেন। যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে এখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। আর সে আতঙ্ককে আরো জোরালো করছেন দেশে থাকা ডগমাটিকরা।
অ্যাসাইলামে নিরাপদ জীবনযাপন করছেন তসলিমা নাসরিনও। কদিন আগেও যিনি নতুন কেনা গাড়ির কথা কৌশলে জানিয়েছেন মানুষকে। অবশ্য মাঝে-মধ্যে ছবিতে, লেখায় তার ‘পশ লাইফ’কে দৃশ্যমান করেন তিনি। তার কাছে বয়ফ্রেন্ড তিন ঘন্টাতেই ফ্যাশফ্যাশে হয়ে যায়, নিজেই জানিয়েছেন তিনি। সম্ভবত তিনিও মানসিকভাবে যৌনদাস চান। যে তাকে পরিতৃপ্তি দিয়ে তিন ঘন্টার মধ্যেই হাপিশ হয়ে যাবে। আবার যখন সে জাগবে, আবার তাকে আনন্দ দিতে চলে আসবে। পুরুষ তার কাছে মূলত ‘জিগোলো’। বাংলাতে পুরুষবেশ্যা।
দেশের একটি দৈনিকে তসলিমা নাসরিনের কলাম পড়লাম, ইরান বিষয়ে। ইরানের চলমান আন্দোলনকে তিনি শুধু হিজাবে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে ইরানের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান চাওয়া আন্দোলনরতদের পোস্টার লিখন। সেসব পোস্টারে তারা ধর্মের বিরুদ্ধে একটা কথাও লিখেনি। তারা কোথাও বলেনি আমরা ধর্ম পালন করবো না। বাংলাদেশের নিরাপদ সড়ক তথা সড়ক সংস্কারের আন্দোলন যেমন রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে পৌঁছেছিলো। ওই বাচ্চারাও বুঝেছিলো সড়ক একটা অনুষঙ্গ মাত্র, মূল দরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার। তসলিমা নাসরিনের চিন্তা ওই বাচ্চাদের চিন্তার সমমানেও পৌঁছাতে পারেনি।
তসলিমা তার সীমাবদ্ধতার করুণ প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার লেখাতেও। তার চিন্তায় শুধু ধর্ম বিদ্বেষ। তাই ইরানের শাসকদের অবসান চেয়েছেন তিনি ধর্মান্ধ শাসক হিসেবে। ইরানের ধর্মান্ধতা যে শুধু বিরোধী মত দমনের জন্য, এটা তার বোধে আসেনি। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় এসব শুধু রাজনীতির উপকরণ মাত্র। না হলে কম্যুনিজমের সূতিকাগার রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য চার্চকে ব্যবহার করা হতো না। অর্থডক্স চার্চের প্রধানকে বলতে হতো না, ‘রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে মারা গেলে সব পাপ মুছে যাবে’। কম্যুনিস্ট রাশিয়াও প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করছে। ইরানেও তাই। এখানে ধর্ম নয়, রাজনীতিটাই বড়। তেমনি তসলিমা শিবলিঙ্গে পানি ঢাললেও, ইসলামের ধর্মীয় আচারের বিরোধিতা করেছেন। এখানেও ধর্মটা তার জন্য সুবিধাবাদ। ভারতের হিন্দুত্বাবাদীদের খুশি করা। আর সুবিধাবাদ সবসময়ই রাজনৈতিক।
হিজাব বিরোধীতা একটি উছিলা, ইরানের মূল আন্দোলন জান ও জবানের নিরাপত্তা আর স্বাধীনতার। ইরানের ফ্যাসিস্ট শাসকরা মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই শাস্তির সম্মুখিন হওয়া। তসলিমার চিন্তার সীমাবদ্ধতা তাকে অতদূর ভাবতে দেয়নি। হিজাব পুড়িয়ে ফেলার অর্থ এই নয় যে, তারা হিজাবের বিপক্ষে। কলম ভেঙে কলম বিরতির যে প্রথা দক্ষিণ এশিয়ায় চালু রয়েছে, সেই বিরতি কলমের বিরুদ্ধে নয়। আন্দোলনে গাড়িতে যে আগুন দেয়া হয়, তাকি গাড়ির বিরুদ্ধে? এমন যদি হতো, তাহলে তো এ ভূখণ্ডে কলম ও গাড়ির ব্যবহার কবেই বন্ধ হয়ে যেত। বিএনপি জোট সরকারের আমলে এক ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়েছিলো, তাকি শুধু ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন ছিলো, নাকি শাসকদের বিরুদ্ধে ছিলো। অথচ এখন কথিত নারীবাদীদের এমন অনেক ঘটনাতেই নীরব থাকতে দেখা যায়। একদম ‘নট নড়নচড়ন’ অবস্থা। তাদের এই সিলেক্টিভ মুভমেন্টের কারণেই বাংলাদেশে নারীবাদ সুবিধাবাদের রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে নারীবাদীদের নিয়ে। বেওকুফরা এই প্রশ্নটাকেই ভুল ভাবে জাজ করছে।
তসলিমারা চিন্তায় এতই সীমাবদ্ধ যে, খোদ ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ইতিহাসও তাদের সঠিক অর্থে জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ভারতের অনেক জায়গায় এখনো ঘুঙটের আড়ালে মেয়েদের মুখ ঢাকা থাকে। পুরুষের সামনে যায় লম্বা কাপড়ে মুখ ঢেকে। কেউ শুনেছেন তসলিমাকে সেভাবে ঘুঙটের বিরুদ্ধে কথা বলতে। শোনেননি। শোনার কথাও নয়। তিনি যদি আদর্শিক হতেন, তবে ঘুঙটের বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। তার কথা হতো ঢেকে রাখার বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশের নারীবাদের কাল্ট প্রধান হিসেবে তিনি সেই সিলেক্টিভ চিন্তা করেছেন। তার ক্ষুব্ধতা শুধু হিজাবের বিরুদ্ধে, ওড়নার বিরুদ্ধে। অথচ দোপাট্টা বা চুনারি’র বিরুদ্ধে তার কোনো আলাপ নেই। ইহুদি সম্ভান্ত্র মহিলারা যে তাবুর মতন কাপড়ে নিজেদের ঢেকে রাখেন, সেটা নিয়ে তসলিমাদের কোনো আলাপ নেই। আলাপ শুধু বোরকার বিরুদ্ধে। তাদের এই আলাপ সিলেক্টিভ, ইসলাম বিদ্বেষের আলাপ। বিদ্বেষ নিয়ে আর যাই হোক শান্তির সংলাপ হয় না।
ভারত-বর্ষে ঘুঙট প্রথা চলে আসছে ইসলামের জন্মের আগে থেকে। ভারত-বর্ষে ইসলাম আসার আগেই প্রচলন ছিলো দোপাট্টা-চুনারি’র। ইসলাম আসার আগে থেকেই ভারত-বর্ষে বাঙলা ভাষাতে পানি শব্দটি প্রচলিত ছিলো। শুধুমাতর্ ধর্মীয় কারণে জল শব্দটির প্রচলন করা হয়েছে। যেমন ভাষার ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতের সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কৃতকে এক অর্থে ধর্মীয় ভাষাও বলা যায়। অথচ যে আরবি’র বিরোধিতা তসলিমারা করেন, তা আরব দেশের মানুষের ভাষা। ইসলাম আসার অনেক আগে থেকেই যে ভাষায় কথা বলা হচ্ছিলো। ইসলাম নতুন কোনো ভাষা সৃষ্টি করেনি। পুরাণে যে শামদেশের কথা বলা হয়েছে, সেই দেশটাই হলো আরব। সুতরাং শাম তথা আরবদেশের সাথে ভারতের যোগাযোগ তখন থেকেই ছিলো এবং তা ইসলামের জন্মের বহু আগের আলাপ। সঙ্গতই সেই শামদেশের ভাষাও ভারতের প্রচলিত ভাষাগুলোর শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। এসবই ইতিহাস স্বীকৃত এবং সে ইতিহাস শুদ্ধ ইতিহাস।
বিদ্বেষের চিন্তা অশুভ। শুদ্ধ ইতিহাসকে এমন অশুদ্ধ চিন্তার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় না, তাদের দিয়ে কোনো ‘বাদ’ই প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, নারীবাদ তো ‘দূর কা বাত’। যেমন সম্ভব নয় নির্বাসিত তসলিমা ও দেশে অন্যদের বেওকুফ ভাবা প্রকৃত বেওকুফদের।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।