ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চিহ্ন বইমেলা হচ্ছে। এই বইমেলায় আমন্ত্রিত হননি দেশের অন্যতম প্রধান লেখক জাকির তালুকদার। তিনি সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন এ ব্যাপারে। সে লেখায় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সরকারি লেখক-কবিদের চক্ষুশূল আমি। আয়োজকদের কী দরকার আমাকে মঞ্চে তুলে বিরাগভাজন হওয়া?’ জাকির ভাই আমার প্রিয় মানুষদের একজন। আমার অনেক প্রিয় মানুষই সত্য বলে এমন বিরাগভাজনদের কাতারে। তবু তো কাউকে কাউকে সত্য বলতে হয়।
‘সরকারি লেখক-কবি’ বলে যে পদবিটা যোগ করলেন জাকির ভাই তাও সত্য। যতদূর জানি, বাংলা একাডেমি ‘লেখক-কবি’দের সরকারি ভাবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ফরম ছেড়েছে। আমার জেলার এক সিনিয়র রিপোর্টার ফোন করে জানলেন, আমি জেলা থেকে ফরম সংগ্রহ করেছি কিনা। কিসের ফরম প্রশ্ন করায় ‘লেখক-কবি সরকারিকরণ প্রকল্পে’র ব্যাপারটা জানতে পারলাম। সাথে এও জানলাম আমার জেলায় বিপুল সংখ্যক ‘লেখক-কবি’ রয়েছেন। একটা দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি সে দেশের সভ্যতাকে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করে। হিসেব অনুযায়ী, হিসেব মানে ‘সরকারি লেখক-কবি’দের যে হিসেব পাই তাতে তো আমাদের দেশের সভ্যতা এতদিনে বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। নোবেল না হলেও সে ধরণের কোনো পুরস্কার অহরহ জোটার কথা। কিন্তু নোবেল তো দূরের কথা ‘কৎবেল’ও জোটেনি। কেন যে জোটেনি!
রাজা-বাদশাদের আমলে রাজকবি বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত ছিলো। বন্দনাকে তারা সাহিত্যের দুর্বল অংশ হিসেবে যুক্ত করেছিলেন। ওই যে, ‘প্রথমে বন্দনা করি’ টাইপ আলাপ আর কী। আমাদের দেশে এরশাদ সাহেবের আমলে রাজকবি বিষয়টি অলিখিত ভাবে চালু ছিলো। রাজা-বাদশা না হলেও কবিতার প্রতি তার আসক্তি থাকায় তিনি তা করেছিলেন। তার কবিতার বইও রয়েছে। যদিও তার কবিতা নিয়ে সে সময় না-না কথা চাউর ছিলো। যাকগে, এরশাদ সাহেব না হয় কবি ছিলেন, তিনি রাজকবি ফর্মটাকেও অঘোষিত ভাবে চালু রেখেছিলেন, কিন্তু এখন কেন আবার নতুন করে ‘সরকারি লেখক-কবি’র বিষয়টি সামনে আনা। তাও আবার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। কবিতা আসক্তি থেকে এরশাদ সাহেব হয়তো লেখক-কবিদের কদর বুঝতেন, তাদের জানতেন। হালের প্রশাসনের লোকজন কীভাবে কবি-লেখকদের বিষয়ে ততটা জানবেন!
অবশ্য জেলা পর্যায়ে যারা প্রশাসক হন, তাদের কাজের একটা অংশই হলো জেলার ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ যারা তাদের সম্পর্কে জানা। তারা হতে পারেন রাজনীতিক, সামাজিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির মানুষ। এক দশক আগে পর্যন্ত দেখেছি, প্রশাসক যারা আসতেন তারা খোঁজ করতেন এমন মানুষদের। তাদের সাথে কথা বলতেন, অফিসে ডাকতেন চায়ের দাওয়াতে। আমি ছোটবেলায় আমার পিতার ক্ষেত্রেও তাই দেখেছি এবং একটা সময়ে নিজের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এখন সম্ভবত সেই বালাই নেই। করোনাকালীন সহযোগিতার অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রেও তাই দৃশ্যমান হয়েছে। যাদের দুঃস্থ লেখক-কবি হিসেবে সহযোগিতা দেয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই কোন অর্থেই লেখক-কবির পর্যায়ের কেউ নন কিংবা দুঃস্থ নন। বই থাকলেই কিংবা কবিতার নামে কিছু একটা লিখলেই লেখক-কবি হওয়া যায় না। আর সত্যিকার লেখক-কবিরা পরিচিতির জন্য অতটা লালায়িত নন এবং লোভীও হন না। তাদের খুঁজে বের করতে হয়। হালের অবস্থা অবশ্য বিপরীত। এখন অনেক ‘লেখক-কবি’রা সরকারি তালিকাভুক্ত হতে ফরম খুঁজে বেড়ান।
সত্যিকার যিনি লিখেন, সে গদ্য বা পদ্য যাইহোক, সে লেখায় তিনি সময়কে ধারণ করেন। আর রাজনীতিটা সে সময়ের বাইরে নয়। ফলে লেখক-কবিকে রাজনীতির ভুলগুলো লিখতে হয়। কখনো সে ভুলের প্রতিবাদও করতে হয়। করাটা একজন লেখক-কবির অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অবশ্য যারা বন্দনাকে বেছে নিয়েছেন তাদের কথা আলাদা। সেজন্যই বলেছি, বন্দনা সাহিত্যের একটি দুর্বলতম ধারা। সত্যিকার যারা লিখেন, তাদের কাছে সবার ঊর্ধ্বে থাকে দেশ। ফিলিস্তিনের মতন একটা জায়গার কবি মাহমুদ দারবিশ বিখ্যাত হয়েছেন নিজের দেশ-মানুষ নিয়ে কথা বলেই। এমন অনেকের নাম বলা যায় এক নিঃশ্বাসেই যে লেখক-কবিরা দেশ ও মানুষের পক্ষে কথা বলে নন্দিত হয়েছেন। অথচ এ বিখ্যাত মানুষগুলোই নিজ দেশে হয়েছেন নিগৃহীত। যারা উনাদের নিগ্রহ করেছেন, তাদের কিন্তু মহাকাল মনে রাখেনি, মনে রেখেছে সেই নিগৃহীত লেখক-কবিদের। মহাকালের হিসেবটা রাজা-বাদশাদের হিসেবের সাথে যায় না।
জাকির তালুকদার তথা জাকির ভাইয়ের কথায় ফিরি, তিনি বলেছেন, ‘লিখতে শুরু করার পর থেকেই বিভিন্ন সরকারের অপকর্মের বিরোধিতা করার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়’। হওয়ার কথাও নয়। আমি যেহেতু গণমাধ্যমে কাজ করি, সেই অভিজ্ঞতাতেই বলি, যখন দেখি দুটো পক্ষই আমার প্রতি অখুশি, তখন বুঝি আমি ঠিক পথে রয়েছি। যারা লিখতে শুরু করেন, তাদের মূলত কোনো পক্ষ থাকে না, কারণ তারা সত্যি কথা বলেন। সে কারণেই তারা সবার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন। যারা সত্যিকার অর্থেই লিখেন, তাদের নিয়তিটাই এমন। যারা সহ্য করে টিকে যান তারা নন্দিত হন। তবে সবার সহ্য শক্তি এক নয়, অনেকেই ঝাঁকের কই হন, ঝাঁকেই মিশে যান। ভোগের আশায় ‘রাজকবি’র পদে সমাসীন হন। আবার কেউ বা হোন ডগমাটিক, মতান্ধ। এদের পরিণতি ওই বন্দনা সাহিত্যের ভাগাড়েই।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।