ছবি : কাকন রেজা
কাকন রেজা :
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনুজ কবি ওয়াহিদার হোসেন এর পোস্ট করা একটি খবরের লিঙ্ক বিব্রত করলো আমাকে। ভারতের বাংলা একটা নিউজপোর্টালের খবর সেটা। যেটা আনন্দবাজারও ছেপেছে। তামিলনাড়ুতে সেরা সাহিত্য সম্মানের জন্য মনোনীত করা হয়েছিলো ‘দলিত’ কবি সুকিরথারানিকে। কিন্তু তিনি সেই সম্মান বা পুরস্কার বর্জন করেছেন। কারণ সে পুরস্কারের স্পন্সর ছিলো ভারতের বিতর্কিত আদানি গ্রুপ। ‘দলিত’ হিসেবে স্বীকৃত তারোপর একজন নারীর যে সাহস আর সক্ষমতা, আমাদের দেশের অনেক ‘অভিজাত’ লেখক-কবিদের তার ছিটেফোঁটাও নেই। কেন নেই, সে ব্যাখ্যা করতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। যেখানে কোনো লেখকদের বই বিক্রি না করার শর্তে বইমেলায় স্টল নিতে হয়। পুরস্কার বর্জন তো ‘দূর কা বাত’, এমন অসাংবিধানিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে দু’কথা বলতে, দু’কলম লিখতেও আমাদের সাহিত্যজনদের বাধে। আজব না?
দলিত ও অভিজাত শব্দ দুটিকে উপরে আমি কমাবদ্ধ করেছি এজন্য যে, আমরা যে সংস্কৃতি লালন করে এসেছি, সেখানে আশরাফ-আতরাফের কোনো ভেদাভেদ নেই। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতিতে দলিত-কুলীন বলে কেউ নেই। আমাদের সংস্কৃতি মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ আমাদের অনেক সাহিত্যজনই এই সংস্কৃতিকে মধ্যযুগীয় মনে করেন। যে সংস্কৃতি মানুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেয়, তাকেই তারা বাদ দিয়ে এগিয়ে যেতে চান। জানি না, তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজেদের কুলীন এবং অন্যদের দলিত ঘোষণা করতে চান কিনা।
কথা থেকে বের হয়ে গেছি। রামপণ্ডিতদের কথা উঠলেই আসল কথা বেরিয়ে আসতে চায়। যে কথাকে মেকি আবরণে ঢাকা হয়েছে। আসি কবি সুকুরথারানির কথায়। আমি তাকে জানি না, জানার কথা নয়। তামিলনাড়ুর সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। জানি এখানেও রামপণ্ডিত কিছু লাফ দিয়ে উঠবেন। উপস্থিত স্যার বলার মতো হাত উঁচু করে বলে উঠবেন, আমি জানি। এদের নিয়ে মহাজ্বালা। দু’কলম বিদেশী লেখকদের লেখা অনুবাদ করেই দিগগজ হয়ে ওঠেন। দেখা যাবে তাদের পড়ার দৌড় ওই দু’কলম পর্যন্তই। নিজেদের অক্ষমতার কারণেই মূলত ধার করেন, অন্যের সাহিত্য অনুবাদে ব্রতী হন। নিজের মৌলিক লেখার যে দৌড় তা অনুবাদ করে বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে যোগ করার অক্ষমতাই মূলত এনাদের অনুবাদ সাহিত্য। তবে ব্যতিক্রম নেই যে তা বলা যাবে না। আমাদের দেশেও আছেন যাদের অনুবাদের মৌলিকত্ব রয়েছে, যাকে অনেকটা ভাবানুবাদও বলা যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম তো উদাহারণ নয়। সবমিলে আমাদের তামিল সাহিত্য জানার উপায় নেই। সত্যিকার অর্থে এক্ষেত্রে ভারতের সাথে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির লেনদেন কতটা, এটা ভাবতে হবে। এক সময় তো আমাদের লেখকদের ভারতের সাহিত্য আঙিনায় প্রবেশ একরকম নিষিদ্ধ ছিলো। হালে বইমেলায় তাও কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন খোলা হয়। অন্য কোনো রাজ্যে প্যাভিলিয়নের চিন্তাও কারো মাথায় নেই। কেন নেই সে ব্যাখ্যা করতে গেলেও মহাকাব্য হয়ে যাবে।
আমরা কিন্তু হিন্দি, উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। মুন্সী প্রেমচন্দ, মির্জা গালিব, কৃষণ চন্দর থেকে হালের গুলজার পর্যন্ত আমাদের ঠোঁটস্থ। আমরা ছোট থেকেই এদের অনেকের বাংলা অনুবাদ পড়ে বড় হয়েছি। আমার বেড়ে ওঠা তো কৃষণ চন্দর, মির্জা গালিব, মান্টো পড়েই। বিপরীতে একটা উদাহরণ দেখান তো দিল্লি কিংবা হায়দ্রাবাদের কেউ বাংলার কোনো অনুবাদ এখন পর্যন্ত পড়েছেন কিনা? আমাদের রামপণ্ডিতরা কী নিয়ে অহঙ্কার করেন? ফাঁপা কলস সব। স্বীকৃত প্রযুক্তির যুগে যে দেশের একজন সায়েন্স ফিকশন লেখক প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, তিনি কোনো সামাজিকমাধ্যমে নেই, সে দেশের এমনসব সাহিত্য ও সাহিত্যজনদের দৌড় বুঝতে কলাবিজ্ঞানী বা ড্রোন সাহিত্যিক হতে হয় না। সঙ্গতই এনাদের মানসিক জোর অতটা নেই যতটা একজন ‘দলিত’ সুকিরথারানির। পুরস্কার প্রত্যাখ্যান নয়, পুরস্কার পাবার কী পরিমান উদগ্রতা তা দেখেছি আমাদের একজন রাজনৈতিক কবির মধ্যে। প্রত্যাখ্যানে কথা বাদ দিন, প্রতিবাদ করার সাহসও এনাদের নেই। উল্টো কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, যেখানে প্রতিবাদের ফলাফল নেই, সেখানে প্রতিবাদ করা নিরর্থক। আশ্চর্য হই ভাবতে, যিনি বা যারা সাহিত্য তথা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করেন তাদের রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক বিষয়ে সামান্যতম ধারণাও নেই! নাকি থাকলেও গুলে খেয়েছেন অভিজাত-কুলীন হবার নেশায়, পুরস্কারের প্রত্যাশায়! নতজানু হওয়ার একটা সীমা থাকে। এনাদের জন্য সম্ভবত কোনো সীমাই নির্ধারিত নেই।
সবশেষে স্যালুট অজানা ‘দলিত’ কবি সুকিরথারানি। আমাদের না জানার ব্যর্থতাকে আপনি ক্ষমা করুন। আমরা ‘অভিজাত’ তো দূর ‘দলিত’ হবারও যোগ্য হয়ে উঠিনি।
কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক