• ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৫২:১২
  • ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৫২:১২
অন্যকে জানাতে পারেন: Facebook Twitter Google+ LinkedIn Save to Facebook প্রিন্ট করুন
বিজ্ঞাপন

আল মাহমুদ, আমাদের রামপণ্ডিতগণ এবং বিভাজনের কাহিনী

ছবি : কাকন রেজা

কাকন রেজা :

আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’ কলকাতার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গলায় গীত হয় খোদ পশ্চিমবঙ্গের ভাষা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে। যেখানে আমাদের তথাকথিত সেক্যুলারকুলের ভাবগুরুদেরও কেউ কেউ ছিলেন। খোদ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ও গুরুদের একজন। তাদের কাছে আল মাহমুদকে সাম্প্রদায়িক অচ্ছ্যুৎ মনে হয়নি। কিন্তু আমাদের অনেকের কাছে আল মাহমুদ পরিত্যাজ্য। ওই যে সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি। রাজা ধরে আনতে বললে পেয়াদা বেঁধে আনে। অবস্থা আমাদের এই রকম আর কী।

আল মাহমুদকে যারা অস্বীকার করতে চান তাদের শ্রেণি দুইটা। একটা হলো মূর্খদের, অন্যটা জ্ঞানপাপীদের। আমাদের দেশে এই দুই শ্রেণিরই আস্ফালন দৃশ্যমান। যারা মূলত আস্ফালনের তাণ্ডবে সাহিত্যকেই হাওয়া করে দিচ্ছেন। যার সুযোগটা নিচ্ছে সুবিধাবাদী অযোগ্য একটা শ্রেণি।

২.

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ‘নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ’ হলো আরেকটা থাপ্পড় আমাদের তথাকথিত অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন পণ্ডিত সমাজের জন্য। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বুঝে হোক আর না বুঝে হোক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। দু’পাতা পড়তে শিখলেই শুধু পণ্ডিত হয় না, যারা পড়তে পারেন না, তারাও হতে পারেন জ্ঞানী মানুষ, এ বিষয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে বিদ্যানন্দ। বলি, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহম্মদ (দ.) এর কথা। উনি উম্মি মানে নিরক্ষর ছিলেন। লালনের কথাও বলি। সুতরাং পাঠের ক্ষমতা অর্জন করাই শেষ কথা নয়। বোঝার ক্ষমতা অর্জনই বড় কথা। উপলব্ধির শানিত উন্মেষই বড় কথা।

হোমার অন্ধ ছিলেন। তিনি বলতেন অন্যজন লিখতেন। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের নিরক্ষেরের গল্পগুচ্ছ তেমনি হোমারদের ক্ষুদ্র সংকলন। এই নিরক্ষর মানুষেরা বলেছেন, অন্যরা লিখেছেন। আমাদের অনেক বড় বড় লেখক নিজেরা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হওয়া সত্বেও চৌর্যবৃত্তি, ভদ্রস্থ করে যাকে বলা হয় প্লেজারিজম, তার আশ্রয় নেন। কেউ তো রীতিমত ঘোস্ট রাইটার পোষেণ। আমাদের দু-একজন নামী-দামী লেখকের ক্ষেত্রেও এমন প্লেজারিজম ও ঘোস্ট রাইটিংয়ের গল্প চালু রয়েছে। এরাই মূলত আল মাহমুদের মতন মানুষদের অচ্ছ্যুৎ করে তুলতে চান। তুলে আনেন সাম্প্রদায়িকতার আলাপ, রাজনৈতিক বিভেদ এবং বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে বিভাজনের নরকে ঠেলে দেন।

৩.

ইংরেজি সাহিত্য তথা কবিতার কথা উঠলে টেড হিউজকে অস্বীকার করার কিছু নেই। এই টেড হিউজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো তার প্রেমিকা আরেক বিখ্যাত কবি সিলভিয়া প্লাথকে হত্যার। নিজ স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগও ছিলো হিউজের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার কবিতাকে কেউ দোষী করেনি। তার সৃষ্টি নিয়ে কারো কোনো আপত্তি ছিলো না। ব্যক্তি হিউজকে সাহিত্য থেকে আলাদা করতে পেরেছিলেন তারা। সভ্য সমাজ সৃষ্টিকে আলাদা করে স্রষ্টার ব্যক্তি সত্তা থেকে। আমাদের সমাজ সম্ভবত অতটা সভ্য হয়ে উঠত পারেনি। কিছুদিন আগ পর্যন্ত নজরুলকেও সাম্প্রদায়িক বলা হতো। এখনো পরিবেশ পেলে কেউ বলে ফেলেন। বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের গানকে ইবাদতের সাথে তুলনা করেন কেউ কেউ। এর কারণ সাহিত্য নয়, সাম্প্রদায়িকতা। এই যে বিভাজন, এরচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িকতা আর কিছু নেই। এমন যারা বলেছেন, তারা সাহিত্য-ধর্ম-মানুষ সব এক করেছেন স্যালাইন ফর্মুলায়। আর সে স্যালাইন তৈরি হয়েছে একটা গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ভাবে সতেজ করার অভিপ্রায়ে। যে অভিপ্রায়ে আল মাহমুদ পরিত্যাজ্য হয়েছেন তাদের কাছে।

 

শেষ কথা : যারা এই কাজগুলো করেন, তারা মূলত ইনফিরিয়র। তাদের যে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তা মূলত নিজেদের ইনফিরিয়র হওয়ার প্রতিক্রিয়া। তারা আল মাহমুদকে সুপিরিয়র জেনেই তাকে অস্বীকার করতে চান। যা মূলত নিজেদের ইনফিরিয়রিটি ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা। সবচেয়ে মজা ও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিশ্বে রেসিজমের সৃষ্টি কিন্তু এই সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে। ‘আমাকে চিনিস’, আমাদের দেশের ‘মুই কি হনু’দের কমন কথা। নিজের ক্ষমতা ও অবস্থানের প্রকাশ ঘটানো হয় এ কথায়। এটা পিওর রেসিজম। অথচ রেসিজমের অনুসারী হয়ে এরা আবার রেসিজমেরই বিরুদ্ধে কথা বলে। নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে জাহির করে। সেলুকাস অবস্থা!

অন্যদিকে মনোবিজ্ঞান একে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নিজ, নিজের শ্রেণি এবং চিন্তাকে সেরা দেখানোর ইচ্ছা এবং তার প্রকাশ এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়া, অহঙ্কার, প্রদর্শনবাদীতা, অন্যের প্রতি সহানুভূতির অভাব ইত্যাদি। আমাদের দেশে এ রোগ আগে থেকেই ছিলো রাজনৈতিক ভাবে। বর্তমানে যার প্রসারণ ঘটেছে বুদ্ধিবৃত্তির জগতে এবং তা ভয়াবহ ভাবে। এখানে কেউ কারো মতের পাত্তা দেন না, সবাই ‘হনু’। সেরা কারা, ‘আমরা আর মামারা’। বলতে পারেন রোগ চরম পর্যায়ে।

কাকন রেজা : লেখক ও সাংবাদিক।

সংশ্লিষ্ট বিষয়

আল মাহমুদ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
Page rendered in: 0.1504 seconds.